কবি তালাশ তালুকদার এক সময় একটি অনলাইন সাময়িকী করতেন; নাম ছিল কীর্তিকলাপ। একবার তিনি আমার একটা সাক্ষাৎকার ছেপেছিলেন। তালাশ মূলত কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন, আমি সেসব প্রশ্নের জবাব লিখে দিয়েছিলাম। প্রশ্নের রীতি কথ্যভঙ্গির হওয়ায় জবাব দেবার ক্ষেত্রে আমার কথা বলার ধরন বজায় রেখেছি।
১। কবিতার কোন সংজ্ঞাটিরে আপনার বিবেচনায় প্রমিনেন্ট মনে হয়? কবিতা নিয়া আপনার আইডিয়া, চিন্তার কথা বলুন। কবিতা নিয়া আপনার কোনো মিশন আছে কি?
কবিতার সংজ্ঞার্থের পেছনে ছুটিনা, নিজে বানাইও নাই; অন্যদের সংজ্ঞার্থ বোঝার চেষ্টা করেছি কখনো কখনো। একটাও প্রমিনেন্ট মনে হয় না; খালি এইটা বুঝছি, যারেই যে-সংজ্ঞা জিগাইবেন (ধরা যাক, সৌন্দর্য, রাজনীতি, ধর্ম, আইন ইত্যাদি নিয়া…) সে-ই বলবে সংজ্ঞার্থের সমস্যা আছে, সব সংজ্ঞার্থই সীমাবদ্ধ। আমিও সেই কাতারে পড়ি। তবে মানি, সংজ্ঞার্থ তৈরি হয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যের অধীন। পোস্টমডার্ন কবিতার সংজ্ঞার্থের সঙ্গে মডার্ন কবিতার সংজ্ঞার্থগত পার্থক্য থাকবেই। দুইটা দুই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা ও চিন্তার ফলাফল। মজার ব্যাপার, দুই সমাজেই কিছু লেখা বা রচনাকে কবিতা বলা হয় বা হয়েছে। কোনো কোনো পোস্টমডার্ন হয়তো কবিতাকে ‘কবিতা’ নাও বলতে পারেন, বলতে পারেন, ‘কবিতা-টবিতা বইলা কিছু নাই, সবই টেক্সট, সানি লিওন থাইকা জিওফ্রে হিল –– সবই টেক্সট, সবাই টেক্সট ইত্যাদি।’
আমি পুরানা তরিকার লোক, বছরের পর বছরে ধরে ছন্দ, অলংকার, রূপকল্পের চমৎকারিত্ব নিয়ে যে জিনিসগুলো কবিতা নামে কাব্যবাজারে চলে আসছে, মানে দেখতে কবিতার মতো লাগে, কানার হাটবাজারের একজন হিসেবে তারেই কবিতা বইলা সাব্যস্ত করি। মনে মনে ভাবি, কবিতা এক প্রকার ম্যাজিক্যাল এন্ড মিউজিক্যাল ভাষারূপ, চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশের এক প্রকার পদ্ধতি। অনেকক্ষেত্রে ইললজিক্যাল মনে হইলেও সেইটা আসলে দিল-লজিক্যাল, দিল — মানে মনের লজিকে চলে।
নাহ আমার কোনো মিশনারি এজেন্ডা নাই, মিশন নাই, তবে সাবমিশন আছে, মানে কবিতার প্রতি নিজেই সমর্পিত। কবিতার মিশন থাকে কি? হয়তো থাকে, আমার নাই।
২। আপনার কবিতা লেখার প্রসেসটা বলেন? ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়া যাইতে কি করেন? (মানে, খেলার আগে ওয়ার্মআপ!) — লেখার আগে একটু পইড়া নেন? নাকি দিব্যি দেখাইতে চান আপনার যাপনচিত্র, নাকি পুরোটাই শ্রম দিয়ে একটা বায়বীয় মেশিনকে সামনে দাঁড় করান?
আমার কবিতা লেখার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রসেস নাই। মনের চুলায় অটো রান্না হইতে থাকে। মাঝে মাঝে লবণ, ঝাল, মসলা চাখার জন্য হয়তো দুই একটা শব্দ ও বাক্যের কান মুচড়ে দেই। তবে ঘ্রাণ নেই, আমার আত্মার ঘ্রাণ। ওয়ার্ম আপ করি না। পইড়া নিব মানে? কী পইড়া নিব? কবিতা? নিজের কবিতা? নাকি অন্যের কবিতা? নাকি যেকোনো কিছু একটা পইড়া নেওয়ার কথা বলছেন? আমি এসব কিছুই করিনা। আমি আমার নিজের অনুভূতিকে পড়তে থাকি। মুহূর্তের আলোয় নিজেকে দেখি বড়জোর। ভাষার সঙ্গে এক ধরনের লীলা চলে, লিপ্ততা চলে, অর্গাজমের আনন্দশেষে কবিতার জন্ম ঘটে হয়তোবা।
ওয়ার্ম হওয়ার জন্য মদ বা মাদকও খাই না। লেখালেখি কোনো-না-কোনোভাবে যাপনচিত্রই; আমার ক্ষেত্রেতো বটেই! কিন্তু কবিতায় অন্যের কণ্ঠও ধারণ করা যায়, যেমন একজন ঔপন্যাসিক পারেন। কুবের বা শশী এরা তো ডিরেক্ট মানিক না। ঢোঁড়াইও সতীনাথ না। আমিও অন্যের অনুভূতির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে লিখি। আত্ম ও অপরের মোলাকাত? — ওইটা হয়ে যায়। বায়বীয়, জলীয় বা বাষ্পীয় কোনো ধরনের মেশিনকেই সামনে দাঁড় করাই না। মেশিনের চেয়ে মন বড় লাগে হে…
৩। কবিতা ও সাহিত্যের অন্যান্য শাখা প্রশাখা (গান, নাটক, ফিল্ম, উপন্যাস, গল্প) এগুলির মধ্য থিকে কোন প্রভাবটা জনজীবনরে বেশি প্রভাবিত কইরা থাকে? তেমনিভাবে সাহিত্যের সঙ্গে শিল্পের অন্যান্য শাখা, প্রশাখা (যেমন, আর্ট, স্থাপত্যবিদ্যা) কোনটার প্রভাব জনজীবনে বেশি দেখা যায়?
জনজীবনকে প্রভাবিত করে থাকে সম্ভবত গান আর ফিল্ম; এইটা আমাকে দেখেই বুঝতে পারি। পপুলার গান আর ফিল্ম সম্পর্কে আমার আগ্রহ দেখেই বুঝতে পারি। শাহরুখ, আমির, প্রসেনজিৎ, শ্রুতি হাসান, জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজের শেষ ছবিটার কথা লোকজন খুব ভালোভাবে জানে। জানে আতিফ, আরিজিতের শেষতম গানটার কথাও। লোকেরা ভালো জানে শিলাকি জওয়ানির খবর। মল্লিকা বা মালাইকার ঝুমুর ঝুমুর নাচের হদিস। কেবল জনজীবন জানে না আল মাহমুদের শেষতম কবিতার বই কোনটি।
জীবন উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত হইত মাঝেমাঝে – সেইটার উদাহরণ হুমায়ূনভক্ত মিডিল ক্লাস তরুণরা, হলুদ পাঞ্জাবিওয়ালা হিমুরা। এর বাইরে কেউ কি তমিজ হইতে চায়? পাভেল হইতে চায় এখন? হাড্ডি খিজির হইতে চায়? কি জানি, জানা নাই…
আর্ট? স্থাপত্যবিদ্যা? কোন আর্ট? কোন স্থাপত্যবিদ্যা? আধুনিকতাবাদী ভাবাদর্শের বাইরে থাকা আমপাবলিকের আর্ট বা স্থাপত্যবিদ্যা? জনজীবন বলতে যদি বুঝি মাস পিপল, আমজনতা, ম্যাঙ্গোপিপল, তাইলে এই দুইটার কোনোটারই প্রভাব নাই। আমজনতার কয় জন সাহাবুদ্দীন, শহীদ কবির অথবা শামীম সিকদার আর নভেরারে চেনে! প্রভাব দেখি নাই! আম পাবলিকের আর্ট বা ভাস্কর্য অচিন শিল্পীর আাঁকা বা বানানো — রিকশার পেছনে থাকে, বাড়িতে মাটির রবীন্দ্রনাথ বা লালন হইয়া বইসা থাকে।
৪। একজন কবিকে মানুষ হিসাবে আপনি কেমন আশা কইরা থাকেন? কবির ব্যক্তিচরিত্র, সামাজিক চরিত্র কেমন হওয়া উচিত বইলা মনে করেন? আপনার যাপিত সময় কবিতায় কতটুকু উঠে আসতেছে? এবং তা কতটুকু বাস্তব-সমাজনির্ভর?
‘মানুষ হিসেবে’ কবিদের নিয়ে আমার বিশেষ কোনো আশা নাই। কবি তো মানুষই। তিনি ডাকাইত মানুষও হইতে পারেন। বিরাট গোঁফ, ইয়া বড় বড় চোখ করে তাকান, দাঁত কটমট করেন, আঙুলে দুই-চাইরাটা আংটি, ঘুষি দিলে নাক থ্যাবড়া হয়ে যাবে। সেই ডাকাইতই হয়তো ভালো বাপ। ডাকাইত যদি ভালো বাপ হইতে পারেন, ডাকাইত ভালো কবিও হইতে পারেন। ডাকাইতির ব্যাকরণ, পিতৃত্বের ব্যাকরণ আর কবিতার ব্যাকরণ যার যার জায়গা থেকে আলাদা। একই ব্যক্তিত্বে এই তিন ব্যাকরণও মিলে যেতে পারে। কবির ব্যক্তিচরিত্র, সামাজিক চরিত্র নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা বা প্রেসক্রিপশন নাই। মাত্রাবৃত্ত ছন্দজানা কত বদ লোক দেখলাম, এরে তারে বাঁশ দিতে চায়। মানবিকতা মনুষ্যত্বের দোহাই পাড়া কত ভালো কবিকে দেখলাম মানুষকে মনুষ্যেতর করতে!
ফলে কবির ব্যক্তিচরিত্র ও সামাজিক চরিত্র নিয়ে ঔচিত্যবাচক চিন্তাও আমার নাই। কারণ কবিদের হাতে মিডিয়াবাজি, পুরস্কার-পদক ছিনতাই, প্রকাশ্য ও গুপ্ত প্রহার সবই তো ঘটছে, ঘটেছে। আবার দেখবেন ম্যাড়মেড়া টাইপের ভদ্রলোক লজ্জাবতী কবিও আছেন।
র্যাঁবো-ভারলেন সমকামী ছিলেন, সেইটা হয়তো বাংলাদেশি সমাজের বড় একটা অংশ মানবেনা। শুনছি, র্যাঁবো চোরকারবারিও ছিলেন, তাই বলে কি তার কবিতা খারাপ হয়ে গেছে। ‘দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য’ — এইটা যদি কেউ মানেন, মানতে পারে। আমি দুর্জন পরিত্যাগ করি, কিন্তু দুর্জনের বিদ্যা পড়তে আমার ব্যক্তিগত আপত্তি নাই।
আমি কেবল এইটা ভাবতে চাই, কবি-অকবি যে-ই হোননা কেন, যা মুখে বলেন, যা লেখেন, যা বিশ্বাস করেন বলে প্রচার করেন, ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনে অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেন কি? পালন করতেই হবে, এমন বলছিনা, এই প্রশ্নটা নিজের কাছে রাখা যাইতে পারে সেল্ফক্রিটিসিজমের জন্য। যদি পালন করতে না পারেন, সেইটাও ফকফকা থাকতে পারে নিজের কাছে বা অন্যের কাছে। বরং পাঠকদের পরামর্শ দেয়া যেতে পারে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘কবি’ নামের গল্পটা পড়তে। তাইলে ভুলেও কবির কবিতায় জীবনচরিত, জীবনচরিতে কবিতা খোঁজার শ্রম ও ঘাম খরচ করবেন না আশা করি।
আমার যাপিত সময় আমার কবিতায় উঠে না আসার কোনো কারণ নাই। কেননা আমি হঠাৎ করে আসমান থেকে নাজেল হই নাই, আমি বাস করি, সময়, স্থান, ইতিহাসের ভেতর। আমার কবিতা কতটুকু বাস্তব সমাজনির্ভর সেটা আমার পক্ষে বলা কঠিন। তবে এটা বলতে পারি, স্থান, সময় ও সমকালীন বাস্তবতা উপস্থাপনে আমার কোনো এলার্জি নাই।
৫। কবিতায় ছন্দ এবং ভাষা এই দুটি উপাদান এক কবি থেকে আরেক কবিকে পৃথক করে কি? আপনার পক্ষপাত কোন দিকে? মুখের ভাষা নাকি লেখনীর ভাষার দিকে? আগামী পঞ্চাশ বছর পর বাংলা কবিতার ভাষা কেমন হইতে পারে?
কবিতার ভাষাকাঠামোর একটি অংশ ছন্দ, যা অবিবার্য নয়। তবে এইটা ব্যবহার করার, না করার টেকনিক ও তৎপরতার কারণে এক কবি থেকে আরেক কবি পৃথক হয়ে যেতে পারেন। ছন্দের ধারণা ও কৌশল প্রয়োগ করা ছাড়াও কবিতার ভাষা তৈরি হতে পারে। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। মুখের ভাষা বা লেখার ভাষা — এই দুইটার মধ্যে আমার কোনো বিশেষ পক্ষপাত নাই; যেইটা যখন কাজে লাগে সেইটারে ব্যবহার করতে আনন্দ পাই। মূলত যে-ভাষার খপ্পরে পড়ি সেই ভাষার সঙ্গে লীলায় মাতি।
পঞ্চাশ বছর পর বাংলা কবিতার ভাষা কেমন হবে? ধূলায় অন্ধকার! দেখতে পারি না কিছুই। এই প্রফেসিটা করতে পারছি না। তবে মনে হয়, ‘মুরাদ টাকলা’ ভাষা (সেদিন জানলাম এই ভাষার মানে। একজন রোমান হরফে লিখেছে, মুরোদ থাকলে আয় — ‘Murad Takla Ay’, অন্যজন পড়ছে, ‘মুরাদ টাকলা আয়’; ধুন্ধুমার কাণ্ড!) — মানে অনলাইন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাষার একটা বড় প্রভাব পড়বে।
আবার নাও পড়তে পারে, হয়তো দেখা গেল কবিরা খুব ক্লাসিক্যাল হয়ে পড়েছেন হঠাৎ করে; পাথর-লোহা-দস্তা-তামা চিবানোর মতো করে কবিতা পড়তে হচ্ছে পাঠকদের। কে জানতো, বহু বছর পর আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ থেকে তরুণদের হাত হয়ে আবারও বের হতে থাকবে রঙিন রঙিন পরাবাস্তব কবিতা, যা ইদানিং দেখা যাচ্ছে! এখন তো বলতেই হয়, মান্নানীয় পরাবাস্তবতা জিন্দাবাদ।
৬। আল মাহমুদ নাকি শামসুর রাহমানরে আগাইয়া রাখবেন? জসীমউদ্দীন কি এ সমাজবাস্তবতায় এখনো গুরুত্বপূর্ণ বইলা মনে করেন? আপনার কাছে রবি ঠাকুরের কবিতা জীবিত নাকি মৃত?
কবিতা ভালো লাগার দিক থেকে আল মাহমুদকে এগিয়ে রাখব। গোল্ডেন এ প্লাস। শামসুর রাহমানের বিশেষ কিছু ভঙ্গি ভালো লাগে। কনফেশনাল কবিতাগুলো। ছন্দের কিছু চাল। মিডিলক্লাস দোনামোনা পড়ে হাসতে বেশ ভালো লাগে।
কবিতাকেন্দ্রিক ভাবনার জন্য বা ইউরো-আমেরিকান আধুনিকতার সমালোচনার জন্য জসীম উদ্দীন এখনও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রবন্ধগুলো পড়া যাইতে পারে আবার। আসলে নিজের সমাজবাস্তবতায় সাবেক-সাবেকেতরকে পড়াও একটা কাজ; প্রাসঙ্গিকতা খোঁজাটাও একটা কাজ। অতীত মানেই ফুরিয়ে যাওয়া নয়। নতুন কবিতা লেখার শর্তেই তাঁর কাছে যাওয়া যেতে পারে।
ঠাকুর জীবিত কি, মৃত? বলেন কি? ঠাকুর কি কোমায় ছিলেন? ঠাকুর মরছে বইলা তো শুনি নাই! বাঁইচা আছেন বইলাই তো জানি। ঠাকুর বাঁইচা আছেন কবিতায়। অন্তত আমার কাছে — প্রশ্নটা যেহেতু আমারেই করছেন। বাঁইচা আছেন গানেও। ঠাকুর-দুখুদের গানকে কবিতার থেকে ফারাক করতে চাইনা যদিও। ঠাকুর জ্যান্ত সাংস্কৃতিকভাবে। ঠাকুরবধকাব্য যতই রচিত হচ্ছে ততোই ঠাকুর জ্যান্ত হচ্ছেন মিডিল ক্লাস মনে, হাই কালচারের স্টেজে।
ঠাকুরের কি দাপট দেখছেন, শানের মতো বলিউডি প্লেব্যাক সিঙ্গার থেকে আরম্ভ করে ট্রাডিশনাল ফোকফিউশনার দোহার, নাগরিক ব্যান্ডদল ভূমি, ক্লাসিক্যাল ওস্তাদ রশীদ খান পর্যন্ত ঠাকুরের গানের ধূলি মাথায় নেন। ওদিকে কমলিনী মুখার্জিরা তো আছেনই। কবির বেঁচে থাকা বলতে আসলে কী বুঝি — সেটার ওপর নির্ভর করছে কাকে বলব বেঁচে আছেন অথবা মরে গেছেন। আমার কাছে রবিঠাকুর টাটকাভাবে জ্যান্ত। একদম ফ্রেস, উইদাউট ফরমালিন, মানে মিডিয়ার কারসাজি, ছাপ্পরবাজি ছাড়াই জ্যান্ত। মানে ঠাকুরের কবিতা আমি পড়ি, ফিল করি। তাঁর কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
৭। বর্তমান সময়ের কলকাতার কবিতা, বাংলাদেশের কবিতা সম্ভাবনা, সফলতা কার কতটুকু? এগিয়েছে, পিছিয়েছে কে কতটা?
আমি এভাবে ভাবি না। সম্ভাবনা, সফলতা, এগুনো, পিছানোও বিচার করতে পারি না। শুধু বুঝি, একই সময়ে দুই সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় কবিতা লেখা হচ্ছে। যদিও এক পর্বে উভয়েরই ছিল কমন হিস্ট্রি। রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিশ্বায়নের কারণে অনুভূতির কোথাও কোথাও মিল তো আছেই। কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক নিরীক্ষাও দুই অঞ্চলে যার যার মতো করে হচ্ছে।
এক প্রান্ত নিশ্চয়ই অন্য প্রান্তকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশ কতোটা প্রভাব ফেলেছে জানিনা, তবে কোলকাতার দাদাগিরি এদেশে একটু বেশিই মনে হয়। নব্বইয়ের অনেক কবির কবিতা পড়ে বিষয়টা জলবৎ তরল লাগে কখনো কখনো। কিন্তু দুই অঞ্চলের মধ্যে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার প্রতিযোগিতা হচ্ছে কি? হচ্ছে না বোধ হয়। সমাজ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অনিবার্যতায় দুই অঞ্চলের সম্ভাবনা দুই দিকেই বিকশিত হবার কথা।
৮। সাহিত্যের সিন্ডিকেট নিয়ে কিছু বলুন? আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন? সে সময়ের কবি বন্ধুদের হাসিমাখা মুখ, প্রকাশ্য সমালোচক, হন্তারক, খাঁটি নিন্দুক, খাঁটি বন্ধু এদেরকে কিভাবে সামলিয়ে ছিলেন? সমালোচনা সাহিত্য কিভাবে নেন আপনি?
ধান-চালের, চোরাককারবারির, তেলের সারের, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট আছে বলেই হয়তোবা সাহিত্যেরও সিন্ডিকেট আছে। থাকুক না। পরাবাস্তবতাবাদীরা, এ্যাংরি, হাংরিরাও তো কাব্যতাত্ত্বিক আন্দোলনের জায়গা থেকে সিন্ডিকেট। কিন্তু সিন্ডিকেট যদি হয় সাহিত্যের উদ্দেশ্যবাদী-মতলববাজি-অসৎ কারবারি, তবে এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নাই। সিন্ডিকেটে আমার পোষায় না, বদহজম হয়। লালন বলে গেছেন, ‘না জেনে করণ কারণ/ কথায় কি হবে!/ কথায় যদি ফলে কৃষি/ বীজ কেনে রোপে।’ শেষ ফলন দেয় কেবলই বীজ! ত্রিস্তা জাঁরার নাম কবিমাত্রই হয়তো জানেন, কয়জন তাঁর একটা কবিতার চাইরটা লাইন জানেন! ওরফে বলে রাখি, আমি কিন্তু উদ্দেশ্যবাদী সিন্ডিকেটের উদাহরণ হিসেবে ত্রিস্তা জাঁরার নাম নিচ্ছি না।
আমার কোনো উত্থান সময় নেই। আমি উত্থিত নই। তাই আমার উত্থান সময়ের গল্পও নাই। ১৯৯৯ সনে তিন মাস শাহবাগে চক্কর দিয়ে বুঝেছিলাম সাহিত্যের ‘কানার হাটবাজার’ কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী? এরপর ওই পাড়ার সঙ্গে বইকেন্দ্রিক যোগাযোগ থাকলেও সাহিত্যকেন্দ্রিক যোগাযোগ আর হয় নাই। এ কারণে শত্রু হবার মতো ঘনিষ্ঠ কবিবন্ধুও জোটে নাই। প্রকাশ্য সমালোচকও নাই। হন্তারক আছে বা ছিল কিনা জানি না। আমার খাঁটি নিন্দুক, খাঁটি বন্ধুরা থাকেন কবিতার অপর পারে। ফলে কিছুই আমাকে সামলাতে হয় নাই। বরং বন্ধুত্বের কথাই বলতে হয়। কয়েকজন অগ্রজ বন্ধু বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন। আমার কয়েকজন কাছের ও দূরের, চেনা ও অচেনা শুভানুধ্যায়ী আমার প্রথম কবিতার বই নিয়ে সহৃদয় রিভিউ ছেপেছেন ও রিভিউ করেছেন। এইটা তো পরম পাওয়া নাকি বলেন! আসলে এগুলো নিয়ে আমার কখনো ভাবনাই হয় না, হয় নাই। সমালোচনা সাহিত্যকে গুরুত্বের সাথে নেই। বইয়ের সমালোচনা বা রিভিউগুলি পড়ার চেষ্টা করি। তবে ‘আমরা আর মামারা’ মিলে সমালোচনা সাহিত্যের আয়োজন থেকে বেরিয়ে আসা যেতে পারে।
৯। ছোটকাগজের সঙ্গে বড় কাগজের গ্যাঞ্জাম সেই পুরনো, হাল আমলেও একই অবস্থা। তো, বড়কাগজের কেউ যদি বড় কবি হয় তবে ছোটকাগজের কবিরা তাকে কি স্বীকৃতি জানাবে না (এভাবে ছোটকাগজের কবির ক্ষেত্রেও একই কথা।)? এই অস্বীকৃতির সংস্কৃতি নিয়া কিছু বলুন? সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশমাধ্যম হিসেবে কোন ক্ষেত্রকে আদর্শ বলে মানেন?
আমি তো কোনো গ্যাঞ্জাম দেখি না! ছোটকাগজ আর বড় কাগজের লেখক বাংলাদেশে কি আলাদা? কই? দেখতে পাই না তো তেমন একটা! একই কবির কবিতা শুক্রবার বা বৃহস্পতিবারে দৈনিকের ব্রডশিটে ছাপা হয়, ফেব্রুয়ারিতে দশটা ছোট কাগজে ছাপা হয়। বড় কাগজ ও ছোটকাগজের পুরস্কার দেয়ার ফর্মুলা, তরিকা এমনকি অনুষ্ঠানের প্রেজেন্টেশনটাও এক।
সাহিত্য নিয়ে বড় কাগজ আর নাম-ডাকওয়ালা ছোট কাগজের মনজিল-এ-মকসুদ প্রায় এক হয়ে গেছে। কেউ আসলে কারো ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বড় কাগজ তো পোছেই না! ওদিকে চলে ছোটকাগজের নিধিরাম সর্দারগিরি! ছোটকাগজ আর বড়কাগজ যেখানে মিলে যায়, সেখানে সোনায় সোহাগা।
ছোটকাগজের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বীর ভাণটা বরং বেশি, ফলে ছোটকাগজের অনেক সম্পাদক-কবি-লেখকই শেষমেষ ভাঁড়ে পরিণত হয়েছেন। ছোটকাগজের সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে বড়োকাগজের ব্যাপটিজমে শামিল হয়েছেন। তো ছোটকাগজের বড়কবি, বড় কাগজের ছোট কবি এই বাইনারি লইয়া কী করিব! কে কাকে স্বীকৃতি দিল, না দিল, তা নিয়ে আমি মোটেও ভাবিনা, তবে মিটিমিটি হাসি পায়। কেন যে পায়!
এ দেশে বড়কাগজের লেখকরাই ছোটকাগজের র্যাডিক্যাল লেখক। ছোটকাগজের লেখকরাই বড় কাগজের সেরা লেখক। সো, নো গ্যাঞ্জাম… ডু ফূর্তি… ঝামেলা কমছে বলে মনে হয়। এক সময় প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রশ্নে এই গ্যাঞ্জামটা ছিল। এখন নাই বললেই চলে। এখন ছোটকাগজ বলতে বোঝায়, বড়কাগজে পাত্তা না-পাওয়া এবং পাত্তা পাওয়া সাহিত্যিকদের লেখালেখির বিমিশ্র সংকলন, যেখানে মফস্বলনিবাসী লেখকদের লেখালেখিও ছাপা হয়। বড় কাগজসূত্রীতার ফলে এক সময় এই ভেদটা ঘুচে যায়। ধীরে ধীরে ব্রডশিটে ছোটকাগজের লেখকদের লেখা ছাপা হতে থাকে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে…!
আসলে ছোটকাগজের আঁভাগার্দ এটিট্যুডই নেই। যেখানে বড় কাগজের লেখক আর ছোট কাগজের লেখকের ভেদ নাই, সেখানে স্বীকৃতি দেয়া না দেয়ার প্রশ্ন আসতেই পারে না। ‘স্বীকৃতি চাই, স্বীকৃতি দে’ — এই এতিম দাবিগুলো আমার কাছে একদম হাস্যকর লাগে। আসলে এগুলোর সঙ্গে এত বেশি ‘ছিঃকৃতি’ বা ‘ছিঃকীর্তি’ মিশে গেছে যে, ওগুলো নিয়ে আমার আর ভাবনা হয় না। এখন ভাবি, কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলোতে এইসব হাবিজাবি ভেবে কত সময়ই না নষ্ট করেছি। বরং কবিতা হিসেবে বাইবেলটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারতাম। ফলে এইসব প্রশ্ন আমাকে এখন আর ভাবায়না। বড় কাগজের বড় কবি? ছোট কাগজের বড় কবি? আছে নাকি? আমি তো খুঁজে পাচ্ছি না! কারা বানায় এসব? তবে হ্যাঁ কিছু কিছু ছোটকাগজ আছে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও কম্প্রোমাইজ করে নি, করে না… সংখ্যায় সেগুলো খুবই কম… কম্প্রোমাইজ না করার ঠেলায় হয়তো ছাপাই হয় না আর। কিন্তু ইতিহাস তাদের ভুলবে না। আমিও ভুলব না নিশ্চয়ই।
প্রকাশমাধ্যম হিসেবে কোনো ক্ষেত্রকে আদর্শ মানার আগে ক্ষেত্র(খেত)গুলোতে তো আগে হালচাষ করতে হবে, বীজ বপন করতে হবে, তাই না? আমি দৈনিক পত্রিকায় চাষ দিয়েছি গোটা পাঁচেক বোধ হয়, ছোটকাগজে দিয়েছি কয়েক ডজন। মানে বড়কাগজে কবিতা ছাপা হইছে গোটা পাঁচেক (একটি আবার একজনের সহৃদয় কৃপায় প্রকাশিত, ছাপাবার আগে জানতাম না ওইটা কৃপা ছিল। আহা, সেই ঋণ পরিশোধের যদি কোনো ব্যবস্থা থাকত, মাবুদ!), আর তিন-চাইরটা ছোটকাগজে কিছু কবিতা। করাঙ্গুলিপরিমেয়। একটা বড় কাগজের সাহিত্যপাতায় কিছু গদ্য লিখছিলাম সাহিত্য সম্পাদকের তড়িৎ আগ্রহে আর আমার ভোদাইগিরিতে। পরে শুনলাম, আমাকে নাকি লেখক ‘বানাইছেন’ তিনি। খোদা, এই রকম প্রডাকশন হাউজে আমি কেন গেছিলাম! তওবা! তওবা! ফলে আর লেখি নাই। চাই নাই আমার লেখার মার্জিনে কারো স্বাক্ষর ও সত্যায়িত সিল মারা থাক। আমার বেশিরভাগ কবিতা ছাপা হইছে ফেসবুকে আমার নিজস্ব দেয়ালে। সেইটাই বোধ হয় উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র আমার জন্য। তা নাহলে এত ছাপলাম কেন! থ্যাংক ইউ মার্ক জোকারবার্গ, যুগ যুগ জীও…
১০। আপনার সময়ে কোন কোন কবিকে সফল, সম্ভাবনাময় মনে করেন? আপনার সময়ের ৫ জন কবির ৫ টি কাব্যগ্রন্থ’র নাম উল্লেখ করুন।
আমার সময় খুব ছোট ফ্রেমে আটকাতে পারি না। ইলাস্টিসিটি বেশি। দশক দশক হিসেব করে আমার মজা লাগে না। কাহ্নপা বা আলাওল কোন দশকের কবি, ভুইলা গেছি। মনে হয় এই সেদিনকার কবি। শেকসপিয়রকে মনে হয় জ্ঞানীগুণী ইয়ারদোস্ত। যাই হোক, শারীরিকভাবে মৃত কবিদের বাদ দিয়ে এক দশকে এটা বুঝে গেছি, আমি বাদে সবাই সম্ভাবনাময়। এদের মধ্যে সফলতম আল মাহমুদ, মাই ফেভারিট ওয়ান। খোন্দকার আশরাফ হোসেন ইন্তেকাল করেছেন। তিনিও সফল ছিলেন। তরুণ কবিদের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলি হয়তো এখনও বের হয় নি, হোক তারপর না হয় নাম বলব। কানে কানে বলি, সফল ও সম্ভাবনাময়দের নাম বলতে নেই, অহংকারী হয়ে উঠতে পারে। পাবলিক পারসেপশন, কবিরা নাকি এমনিতেই ভীষণ অহংকারী। তাছাড়া এইটা তো বাংলাদেশ…!