বিদ্যাসাগর বঙ্গদেশে এমন এক সময়ে জন্মেছিলেন যখন প্রতিভাবান কোনো ব্যক্তিকে যুক্ত থাকতে হতো বহু কাজের সঙ্গে। রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর — সবাই কোনো-না-কোনোভাবে বহু ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।
‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ বলতে একটি কথা প্রচলিত আছে বাংলা ভাষায়; তার নিদর্শন আদতে এঁরা প্রত্যেকে। সমাজকে বদলাতে হবে, ধর্মকে বদলাতে হবে, লেখার ভাষাকে বদলাতে হবে, পাঠ্যপুস্তক লিখতে হবে, ব্যাকরণ লিখতে হবে — সব কাজে কোনো-না-কোনোভাবে যুক্ত হয়েছেন বিদ্যাসাগর। হয়তো একেই বলে প্রতিভার বিচ্ছুরণ। বিদ্যাসাগর ভাবুক ও কর্মী। এখনকার বাংলাদেশে যতো ভাবুক পাওয়া যায়, ততো কর্মী পাওয়া মুশকিল। অন্য দিকে উত্তর-আধুনিকতার ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ ভাঙার ধাক্কায় বিদ্যাসাগররা প্রায় ছিটকে পড়েন পথ থেকে। কিন্তু চাইলেই কি উৎখাত করা যায়? বিরাট বিপুল সৃষ্টিস্তম্ভ প্রোথিত হয়ে রয়েছে বাঙালির মর্মমূলে, তার উচ্ছেদ সাধন সহজ কাজ নয়। আমরা তাই চোখ ফিরিয়ে দেখে নিতে চাই বিদ্যাসাগরের কাজের ক্ষেত্রগুলো।
শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্র ভাঙা
বিদ্যাসাগরের সব চেয়ে বড় ধাক্কা ছিল বিধবাবিবাহ বিষয়ক সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করা, তার প্রয়োগ এবং আইনি বৈধতা অর্জন। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার কাজ এটি নয়। বিধবাবিবাহ না হওয়াটাই ছিল তখনকার দিনের ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ বা ‘মহাবয়ান’। হাতুড়ি ঠুকে এই বয়ান ভাঙা সম্ভব নয়। ‘মারো ঠেলা, হেইয়ো, আরও জোরে, হেঁইয়ো’ বলে বিধবাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যায়নি। বিদ্যাসাগরের সম্মুখভাগে ছিল বহু কাল ধরে বহমান দেশাচার, লোকাচার ও শাস্ত্র। দেশাচারকে আজকের পরিভাষায় বলতে পারি ‘সংস্কৃতি’। তিনি জানতেন, সংস্কৃতি বা দেশাচারের সীমানা ডিঙিয়ে বিকল্প প্রস্তাব প্রতিষ্ঠা করা ভীষণ কঠিন একটি কাজ। একজন বিধবার শরীর-মনের আবেগের চেয়ে এদেশে বড় সত্য দেশাচার ও শাস্ত্র। বিদ্যাসাগর খানিকটা অযৌনভাবে বলেছেন, ‘বৈধব্যযন্ত্রণা’। কিন্তু যন্ত্রণারও নানা দিক ছিল; তা শুধু শরীর বা মন ঘিরে নয়। বিধবার সামাজিক, পারিবারিক বা আর্থিক নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু ব্যভিচার ও ভ্রূণহত্যার দায়ভার শেষ পর্যন্ত গিয়ে গড়াত বিধবার কাঁধেই।
বিদ্যাসাগর এও জানতেন, এদেশের মানুষ শাস্ত্রের অনুগত; শাস্ত্র দিয়েই নিরূপিত হবে বৈধ ও অবৈধ। আর তাই তিনি ফিরে গেলেন শাস্ত্রের কাছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা, অর্থাৎ শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। একে একে দেখালেন কোন শাস্ত্রে কী আছে? কোনটি গ্রহণযোগ্য? কেন গ্রহণযোগ্য? কেন গ্রহণযোগ্য নয়? শাস্ত্র বলতে কী বোঝানো হবে? সত্যি কথা বলতে কি, বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব যেন একটি গবেষণা-পুস্তক; কোনো একটি গবেষণায় যেমন গবেষণা-জিজ্ঞাসা থাকে, উপাত্ত বিশ্লেষণ থাকে, কার্যকরী সংজ্ঞার্থ থাকে কিংবা থাকে যৌক্তিক ধারাবাহিকতা — এ-বইয়ে তা-ই আছে। অন্যদের বক্তব্যকে তিনি খণ্ডন করেছেন তথ্য, প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে।
যুক্তি উপস্থাপনের এরকম ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাপ্রোচ’ উনিশ শতকের খুব কম বইয়েই আছে। শাস্ত্র খণ্ডন শেষে বিদ্যাসাগর বলছেন, ‘আপনারা ইহাও বিবেচনা করিয়া দেখুন, আমাদের দেশের আচার এক বারেই অপরিবর্তনীয় নহে। ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না, সৃষ্টিকাল অবধি আমাদের দেশে আচার পরিবর্ত হয় নাই; এক আচারেই পূর্বাপর চলিয়া আসিতেছে। অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে, আমাদের দেশের আচার পদে পদে পরিবর্তিত হইয়া আসিতেছে। পূর্বকালে এ দেশে চারি বর্ণের যেরূপ আচার ছিল, এক্ষণকার আচারের সঙ্গে তুলনা করিয়া দেখিলে, ভারতবর্ষের ইদানীন্তন লোকদিগকে এক বিভিন্ন জাতি বলিয়া প্রতীতি জন্মে। বস্তুত: ক্রমে ক্রমে আচারের এত পরিবর্ত হইয়াছে যে, ভারতবর্ষের ইদানীন্তন লোক, পূর্বতন লোকদিগের সন্তান-পরম্পরা, এরূপ প্রতীতি হওয়া অসম্ভব।’
বিদ্যাসাগর এও বলেছেন, শাস্ত্রের ব্যাখ্যাসূত্রে অনেক বিষয়েই নতুন সমস্যার মীমাংসা করা হয়েছে। তাহলে বিধবাদের বিয়ে দেবার বেলায় সমস্যা কোথায়? তিনি দেখাচ্ছেন, শাস্ত্র নয়, দেশাচার বা সংস্কৃতিই সমস্যা। বিদ্যাসাগর বলছেন, ‘দেশাচারের দোহাই দিয়া, আর আপনাদের অসম্মত থাকা উচিত নহে।’ অনেকে মনে মনে বিধবাবিবাহে সম্মত হয়েও ‘দেশাচারবিরুদ্ধ’ বলে প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ ছিলেন। বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘হায়, কি আক্ষেপের বিষয়, দেশাচারই এ দেশের অদ্বিতীয় শাসনকর্তা, দেশাচারই এ দেশের পরম গুরু; দেশাচারের শাসনই প্রধান শাসন, দেশাচারের উপদেশই প্রধান উপদেশ।’ অথচ শত শত ক্ষেত্রে শাস্ত্রাচার লঙ্ঘিত হচ্ছে, ভারতবর্ষীয়রা দেশাচারবিরুদ্ধ কাজে যুক্ত হচ্ছে। কেবল বিধবাবিবাহের বেলায় লোকলজ্জা!
বিধবার বিয়ে দিতে সম্মতি নেই, কিন্তু ‘দুর্নিবাররিপুবশীভূত হইয়া ব্যভিচারদোষে দূষিত’ হলে তার পোষকতা করতে, ভ্রূণহত্যায় সহায়তা করতে ‘সপরিবারে পাপপঙ্কে কলঙ্কিত’ হতে কোনো সমস্যা বোধ করছে না। দেখা যাচ্ছে যে, বিধবার বিয়েই শুধু নয়, যৌনাচার থেকে জন্মপ্রাপ্ত সন্তান হত্যার প্রসঙ্গকেও বিদ্যাসাগর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বিদ্যাসাগরের এ লড়াই প্রতিষ্ঠিত শাস্ত্র, দেশাচার ও লোকাচারের বিরুদ্ধে।
বহুবিবাহের বিরুদ্ধে
বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও বিদ্যাসাগর বিরাট এক বই লিখেছেন — বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব। এটিও গুরুত্বপূর্ণ বই; যদিও খুব বেশি আলোচিত হয় না। গবেষণার দৃষ্টিতে দেখলে এই বইও বিস্ময় জাগানিয়া। বিপুল পরিমাণ তথ্য, যুক্তি ও উপাত্ত দিয়ে নিজস্ব প্রস্তাব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগর শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্র খণ্ডন করেছেন। তবে এও বলেছেন, ‘অধুনা এ দেশের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে রাজশাসন ব্যতিরেকে, ঈদৃশ দেশব্যাপক দোষ নিবারণের উপায়ান্তর নাই।’ বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে যারা সরকার বরাবর আবেদন পেশ করেছিলেন বিদ্যাসাগর তাদের পক্ষাবলম্বন করেছেন এবং বিরোধী পক্ষের আপত্তি খণ্ডন করেছেন। একটি আপত্তি ছিল এই যে, যখন কুলীন ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ছিল এদেশে তখন অনেকে বহুবিবাহ করতেন। পাল্টা যুক্তি দিয়ে বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘কুলীনদিগের পূর্ববৎ অত্যাচার নাই, এই নির্দেশ সম্পূর্ণ প্রতারণাবাক্য।’ আর প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন হুগলী জেলার কুলীনদের বহুবিবাহকেন্দ্রিক বিপুল তথ্য; এর মধ্যে প্রথম ব্যক্তির বয়স ৫৫, বিয়ে করেছেন ৮০টি। ১৮ বছর বয়সী একজন বিয়ে করেছেন ১১টি। বিদ্যাসাগর বিভিন্ন সূত্রে তথ্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে এসব হাজির করেছেন।
কিন্তু বিদ্যাসাগর কেন বহুবিবাহের বিরুদ্ধে? বিধবাবিবাহ প্রচলিত না হওয়ায় সমাজে যে-ধরনের অসংগতি দেখা দিয়েছিল একই ধরনের অসংগতি তৈরি হয়েছিল বহুবিবাহ সংঘটনের ক্ষেত্রেও: ব্যভিচারদোষ ও ভ্রূণহত্যা। কারণ কুলীন বাবুরা বিয়ে করে অর্থ-অলংকারাদি-সমেত সেই যে গিয়েছেন আর দেখা নেই। এমনও হয়েছে বিয়ের রাতেই প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ সংঘটিত হয়েছে। বহুবিবাহ প্রথাকে বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘নৃশংস প্রথা’। তিনি বলেছেন, ‘বহুবিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকাতে, অশেষপ্রকারে হিন্দুসমাজের অনিষ্ট ঘটিতেছে। সহস্র সহস্র বিবাহিতা নারী, যার পর নাই, যন্ত্রণা ভোগ করিতেছেন। ব্যাভিচারদোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের স্রোত প্রবল বেগে প্রবাহিত হইতেছে।’ সমাধান কী? বিদ্যাসাগর মনে করেন, ‘রাজশাসন’ দিয়েই এই প্রথা দূর করা সম্ভব। সমাজ কি পারে না প্রথাকে বদলে দিতে? বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘আমাদের ক্ষমতা কোথায়।… ইচ্ছা নাই, চেষ্টা নাই, ক্ষমতা নাই, সুতরাং সমাজের দোষসংশোধন করিতে পারিবেন না।’ অতএব বিদ্যাসাগরের আইনেই ভরসা।
পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা
বিদ্যাসাগর ছিলেন উনিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা। নিজে শিক্ষক ছিলেন; লিখেছেন পাঠ্যবই। তার জীবিতাবস্থায় এবং মৃত্যু-পরবর্তী কালে প্রতিটি বইয়ের অজস্র সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সেসব বইয়ের মধ্যে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে বর্ণপরিচয়— প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ; এই বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন তিনি; প্রথমত: বাংলা ভাষায় দীর্ঘ ঋ-কার এবং দীর্ঘ লি-কারের প্রয়োগ নেই বলে, সে দুটি বর্জন করেছেন। দ্বিতীয়ত: অনুস্বর ও বিসর্গকে স্বরবর্ণ হিসেবে গণ্য না করে ব্যঞ্জনবর্ণ হিসেবে পরিগণিত করেছেন। তৃতীয়ত: চন্দ্রবিন্দুকে একটি স্বতন্ত্র বর্ণ বলে গণ্য করেছেন। চতুর্থত: ড, ঢ, য এবং ড়, ঢ়, য়-কে স্বতন্ত্র বর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পঞ্চমত: ক ও ষ যুক্ত হয়ে ক্ষ হয় বলে অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের তালিকায় ক্ষ-কে রাখেননি।
ভাষাশিক্ষা, শিশু-মনস্তত্ত্ব বিষয়ে বিদ্যাসাগর বিস্তর ভেবেছেন; তার প্রমাণ বইয়ের ভূমিকায় পাওয়া যায়, ‘ক্রমাগত শব্দের উচ্চারণ ও বর্ণবিভাগ শিক্ষা করিতে গেলে অতিশয় নীরস বোধ হইবেক ও বিরক্তি জন্মিবেক, এজন্য মধ্যে মধ্যে এক একটি পাঠ দেওয়া গিয়াছে। অল্পবয়স্ক বালকদিগের সম্পূর্ণরূপে বোধগম্য হয়, এরূপ বিষয় লইয়া ঐ সকল পাঠ অতি সরল ভাষায় সংকলিত হইয়াছে। শিক্ষক মহাশয়েরা উহাদের অর্থ ও তাৎপর্য স্ব স্ব ছাত্রদিগকে হৃদয়ংগম করিয়া দিবেন।’
বিদ্যাসাগর শিক্ষার্থীদের জন্য অনুবাদ করেছেন ঈশপের গল্প। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষক থাকাকালে সে সময়কার শিক্ষাকর্মাধ্যক্ষ উইলিয়াম গর্ডন ইয়ঙের পরামর্শে তিনি অনুবাদ করেন ঈশপের গল্প। এক্ষেত্রে তার মূল অবলম্বন ছিল রেভারেন্ড টমস জেমসের ইংরেজি অনুবাদ। বিদ্যাসাগর নিজের বইয়ের নাম দিয়েছিলেন কথামালা। তার ভাষায়, ‘গল্পগুলি অতি মনোহর; পাঠ করিলে, বিলক্ষণ কৌতুক জন্মে, এবং আনুষঙ্গিক সদুপদেশ লাভ হয়।’ এই বই এতটাই পাঠকপ্রিয় হয়েছিল যে, এখনও অনেকের মুখে হুবহু শোনা যায়, ‘একদা, এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল।’
‘বালকদিগের লেখা পড়ায় অনুরাগ জন্মিতে ও উৎসাহবৃদ্ধি হইতে পারে’ — এ লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর লিখেছেন চরিতাবলী। মূলত ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যক্তিত্বকে নিয়ে রচিত এ বইয়ে উঠে এসেছে অধ্যবসায়, সেবা, পরিশ্রম, মহানুভবতার গল্প। শিক্ষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, শিশু-মনস্তত্ত্বকে নৈতিক ও দায়িত্বশীলতার কাঠামোতে নিয়ে আসার চেষ্টা ছিল বিদ্যাসাগরের। একই ধরনের বই জীবন চরিত। এটি মূলত রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্স রচিত জীবনীগ্রন্থ অবলম্বনে রচিত। বিদ্যাসাগর মনে করেন, জীবনচরিতপাঠে দুই ধরনের উপকার হয়; প্রথমত: সংশ্লিষ্ট মহাত্মারা কী ধরনের পরিশ্রম, উৎসাহ, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ় অধ্যবসায়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য ও নিগ্রহ অতিক্রম করেছেন তা থেকে শিক্ষা লাভ করা যায়। দ্বিতীয়ত: সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানের রীতিনীতি, ইতিহাস ও আচার সম্পর্কে জানা যায়। শিক্ষাতত্ত্ব শুধু নয়, জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যাসাগরের এই পর্যবেক্ষণ শতভাগ সত্য।
বাংলা গদ্যের জনক
বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে এই অভিধাটি দেওয়া হয় যে, তিনি বাংলা গদ্যের জনক; প্রকৃতপক্ষে এটি এক ধরনের অতি-কথনে পরিণত হয়েছে। কারণ উনিশ শতকের অনেক আগেই বাংলা গদ্যের প্রচলন ছিল। উনিশ শতকেই বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী লেখকবৃন্দ গদ্য লিখেছেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকাররা প্রবল ভক্তিবশত বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে জনকের উপাধি প্রয়োগ করে থাকেন, যা প্রকৃতপক্ষে বাংলা গদ্যের ইতিহাসকে একপেশে ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। বাংলা গদ্যে বিদ্যাসাগরের প্রকৃত অবদান হলো গদ্যকে সাহিত্যিক গদ্যে রূপান্তরিত করা।
প্রাচীন সংস্কৃততাত্ত্বিকরা যেমন রসাত্মক বাক্যের কথা বলেছেন, বিদ্যাসাগর ঠিক তেমন ধরনের রসাত্মক, অনুভূতিসম্পন্ন ও সংবেদনশীল ভাষা উপহার দিয়েছেন। তবে এই ভাষার বিপদও ছিল; যা পরবর্তী কালের বাংলা গদ্যে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছে, সেটি সংস্কৃত ভাষামুখিনতার বিপদ। এমন অনেক অনেক সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহার করেছেন বিদ্যাসাগর যা বাংলা ভাষার সঙ্গে খাপ খায় না।
অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ ও ভাষার জোরালো প্রভাব পড়েছে বাংলায়। বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন বলতে যে-কথা প্রচলিত সে অভিযোগের খানিকটা ভাগ বিদ্যাসাগরের ওপরও বর্তায়। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিদ্যাসাগর কেবল একটি শৈলীর গদ্য রচনা করেন নি। সীতার বনবাস বা শকুন্তলার গদ্যের সঙ্গে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব, অতি অল্প হইল, আবার অতি অল্প হইল প্রভৃতি রচনার ভাষাশৈলি এক নয়।
বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব বইয়ে তিনি অনেক বেশি যুক্তিকাঠামো প্রস্তুতে মগ্ন। অতি অল্প হইল ও আবার আতি অল্প হইল প্রভৃতি বইয়ে ভাষাকে করে তুলেছেন রসাত্মক। তাকে যেহেতু রসাত্মক ভাষায় ব্যঙ্গবিদ্রূপ দ্বারা আক্রমণ করা হয়েছিল সেহেতু জবাবে তিনিও দিয়েছেন পাল্টা বিদ্রূপাঘাত। বলা যায়, প্রয়োজন ও প্রসঙ্গ অনুযায়ী ভাষারীতির পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তার প্রথম দিককার লেখায় সংস্কৃতানুসরণ যতোটা প্রবল ছিল, ধীরে ধীরে তা কমে এসেছে। মূলত রীতিগত সচেতনতা এবং তার প্রয়োগ বিদ্যাসাগরের গদ্যকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় উন্নীত করেছে।
লিবারেল হিউম্যানিস্ট
বিদ্যাসাগর মূলত উদার-মানবিকতাবাদী ঘরানার লেখক ও ভাবুক। ইউরোপীয় মানবতাবাদের বঙ্গীয় প্রতিনিধি তিনি। রেনেসাঁ ও এনলাইটেনমেন্টের ধারাবাহিকতায় তিনিও এক আলোকসঞ্চারী ব্যক্তিত্ব। পাশ্চাত্য জ্ঞান, বিদ্যা ও আদর্শকে উপেক্ষা করতে পারেননি, ওদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রচিন্তাকেও প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। যে-শাস্ত্রচিন্তা মানব ও সমাজের কল্যাণে কাজে লেগেছে তাকেই তিনি প্রয়োগ করতে চেয়েছেন সমাজের সংস্কারে। প্রাচীন শাস্ত্রের সমকালীন প্রয়োগ ইউরোপীয় রেনেসাঁর ইতিহাসেও দৃশ্যমান।
বিদ্যাসাগরের মনেও ছিল ইউরোপ বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা, ছিল জ্ঞান, বিদ্যা, শিক্ষাকে আলোক সঞ্চারের মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা। যুক্তি ও আইনের প্রতি তার অগাধ আস্থার কারণও নিহিত এই দৃষ্টিভঙ্গির মর্মস্থলে। একটি উদাহরণ পেশ করা যাক তার চরিতাবলী থেকে। ‘জেঙ্কিন্স’ নামক চরিতকাহিনিতে দেখা যাচ্ছে আফ্রিকান কাফরি বালক জেঙ্কিন্সকে তার বাবা ইউরোপীয় বিদ্যায় শিক্ষিত করার জন্য স্কটল্যান্ডের একজন ক্যাপ্টেন মারফত ইউরোপে পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয় পেরিয়ে সে শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। এই আপাত-নিরীহ গল্পে নিঃসন্দেহে অধ্যবসায়, দায়িত্ববোধ ও জ্ঞানতৃষ্ণার পরিচয় পাওয়া যায়।
কিন্তু এর সঙ্গে এও স্পষ্ট হয়েছে যে, ইউরোপ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মনোভঙ্গি কী। তিনি লিখেছেন, ‘য়ুরোপীয় লোকেরা লেখা পড়া জানেন বলিয়া, কাফরিজাতি অপেক্ষা সকল অংশে উৎকৃষ্ট; ইহা দেখিয়া, কাফরিরাজ, আপন পুত্রকে লেখা পড়া শিখাইবার নিমিত্ত, নিরতিশয় ব্যগ্র হইলেন, এবং, স্কট্ল্যান্ডনিবাসী স্বানষ্টন নামক এক জাহাজি কাপ্তেনের নিকট প্রস্তাব করিলেন, যদি আপনি আমার পুত্রকে, স্বদেশে লইয়া গিয়া, সুশিক্ষিত করিয়া আনিয়া দেন, তাহা হইলে, আমি আপনকার সবিশেষ পুরস্কার করিব…’
এই উক্তি স্পষ্ট করে যে, এক. ইউরোপীয়রা শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট, দুই. স্বদেশে প্রকৃত শিক্ষা নেই; উনিশ শতকের বাংলা জুড়ে এই ভাবাদর্শই প্রচলিত ছিল। উপনিবেশ-শাসিত অঞ্চলগুলোকে এই কথাই বারবার করে শোনানো হয়েছে।
বিদ্যাসাগর তার থেকে মোটেও দূরে ছিলেন না। তার চিন্তা ও মনন গড়ে উঠেছিল ইউরোপবাহিত জ্ঞানের ভিত্তিভূমিতে। তাই তার আদর্শ ব্যক্তিদের সবাই মূলত ইউরোপের বাসিন্দা। কাকতালীয়ভাবেও তাদের কেউ ইউরোপবহির্ভূত নন। হয়তো তাই বিদ্যাসাগর রচিত শিশুপাঠ্য বইগুলোর অধিকাংশ হয় ‘ইঙ্গরেজী পুস্তক হইতে সঙ্কলিত’, নয় ইংরেজি থেকে অনুবাদ।
প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয় শাসন ও ঔপনিবেশিক ইতিহাস সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের কোনো ক্রিটিক্যাল মূল্যায়ন নেই। ইউরোপকে তিনি আলোকের উৎস হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন; মার্শম্যানের ইতিহাসগ্রন্থ অবলম্বনে লিখিত বাঙ্গালার ইতিহাস বইয়ে বিদ্যাসাগর সিরাজদ্দৌলাকে নিতান্তই ‘দুরাচার’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু লর্ড বেন্টিক অনেকটাই নায়কসুলভ মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছেন বিদ্যাসাগরের বয়ানে।
কারণ তিনি ‘ইংরেজি শিক্ষায় সবিশেষ উৎসাহ দিয়াছিলেন।’ কারণ ‘দেশীয় লোকদিগকে য়ুরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা শিখাইবার নিমিত্ত, কলিকাতায়, মেডিকেল কলেজ নামক বিদ্যালয় স্থাপিত করিয়া, দেশের সাতিশয় মঙ্গলবিধান করিয়াছেন।’ বেন্টিকের সময়কার নানা রকম দৃশ্যমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক রূপান্তর — যেমন: জাহাজ চলাচল, সংবাদ আদান-প্রদান, শিক্ষাবিস্তার, ইংরেজি ভাষাচর্চা ইত্যাদি দেখিয়ে বেন্টিকের শাসনপর্ব সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এক দিবসের জন্যও, সন্ধি ও শান্তির ব্যাঘাত ঘটে নাই। তাহার অধিকারকাল কেবল প্রজাদিগের শ্রীবৃদ্ধিকল্পে সঙ্কল্পিত হইয়াছিল।’ মূলত ইউরোপীয় উদার মানবিকতাবাদের আলোয় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ইংরেজ শাসনের নৃশংসতম রূপগুলো।
তবুও বিদ্যাসাগর
বিধবাদের জন্য অনেক কল্যাণকর কাজ করলেও, ‘বালক’দের জন্য অনেক বই লিখলেও বাংলার বৃহত্তর অংশ মুসলমানদের শিক্ষা ও উন্নতির ব্যাপারে বিদ্যাসাগরকে তৎপর হতে দেখা যায় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তীব্র সমালোচনা করলেও, অন্য অনেকের মতো তিনিও মনে করতেন ‘স্ত্রীজাতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল।’ তবুও বিদ্যাসাগর ‘বিদ্যাসাগর’ই। জ্ঞান, বিদ্যা, মনুষ্যত্ব, সেবা, দান, কল্যাণ — এসবের এক মহৎ মনুষ্য-মূর্তি ছিলেন তিনি। ধর্ম প্রসঙ্গে তার কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না। উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হয়ে শিক্ষার ভারে গর্বে উদ্ধত হয়ে ওঠেননি তিনি।
বিদ্যাসাগর হয়ে উঠেছিলেন চলমান কিংবদন্তি। জনতার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অন্তরের। যে কাজেই তিনি যুক্ত হয়েছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তা পালন করেছেন। বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বিরাট এক মাইলফলক বিদ্যাসাগর; আজকালকার বাঙালির মননগত ইতিহাসের বিবরণ নিতে গেলে সেই ফলকেই চোখ পড়ে সবার আগে। আর তাই দুইশো পরও মনে হয় কোনো এক ল্যাম্পপোস্টের নিচে স্বল্প আলোর আচ্ছাদনে চুপচাপ পড়ছেন এক বিদ্যাসাগর। এই একগুঁয়ে মানুষটি সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন। আজকের বাংলাদেশে ইতিবাচক আলোড়ন কজন তুলতে পারে?