লাল দেদ কাশ্মীরি কবি ও সাধক। জন্ম ১৩২০-এ। বিভিন্ন নামে তিনি পরিচিত — লালেশ্বরী, লাল দেদ, মা লালা, লালা আরিফা, লাল দিদি, লাল যোগোশ্বরী। শৈব ঘরানার কবি তিনি। কাশ্মীরি ধর্ম ও সংস্কৃতিতে প্রভাববিস্তারী এই কবি স্বীকৃতি পেয়েছেন ধর্মনির্বিশেষে।
শ্লোক : ২
আমার পায়ের ছাপে সমস্ত প্রকৃতি আমি পুড়িয়ে ফেলেছি তাঁর খোঁজে
সহসাই মনে এলো : কী ভাবছি আমি, তিনি তো সবখানে!
শত কথার শত টুকরো থেকে লালা পেয়েছে এই সত্যের বোধ।
এখন তোমরা শোনো সেই কথা, হে মানুষ, যাও উন্মাদ হও!
শ্লোক : ৩
শিব অথবা কেশব অথবা উজ্জ্বলতম সেইজন অথবা পদ্মজাত,
যে নামেই তিনি নিজেকে ডাকুন,
আমার আকাক্সক্ষা শুধু শুদ্ধ করে দেবেন তিনি অকৃতি অধম এই
নারীর জীবন, তিনি, হ্যাঁ তিনিই, তিনি অথবা তিনি অথবা তিনি।
শ্লোক : ৪
গহিন সমুদ্র — সুতো বেঁধে গুণ টেনে পার করছি আমার নৌকো,
তিনি কি শুনবেন আমার প্রার্থনা অথবা ডিঙিয়ে দেবেন অকুল পাথার?
অথবা আমি কি চুইয়ে পড়ছি ভাঙাচোরা পাত্র থেকে জলের মতন?
হায়, হৃদয় আমার, তোমার বাড়িতে হবে না ফেরা।
শ্লোক : ৫
তোমার জন্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি, হে আত্মা আমার।
‘মায়া’র বিভ্রমে হারিয়ে ফেলেছো তুমি তোমার হৃদয়।
ভুলে গেছো কে তুমি। এই লোহার নোঙর, এমনকি
এর ছায়াও থাকবে না তোমার সঙ্গে — যখন আসবে সময়।
শ্লোক : ৬
যে-পথে আমি গিয়েছিলাম সে-পথে আমি পৌঁছি নি,
তীরে এসে দাঁড়িয়ে দেখি ফাটল ও সেতু, ফুরিয়ে এসেছে দিন।
ঝোলা হাতড়ে খুঁজে দেখি মাঝিকে দেবার মতো একটিও নেই কড়ি।
শ্লোক : ৮
তারা আসছে, তারা আসছেই, এইবার বিদায়ের পালা,
দিন আর রাত্রি জুড়ে তাদের গমনাগমন,
কোত্থেকে আসছে, আর যাচ্ছে কোথায়।
শূন্য থেকে শূন্যে, শূন্য থেকে শূন্যে, কেন?
শ্লোক : ৯
কোত্থেকে এসেছি আমি? অথবা কোন সে রাস্তায়?
আমাকে পৌঁছুতে হবে কোন সে গন্তব্যে? আমি কি
পাবো সেই পথের দেখা? আশা করি, দেরি হবার আগেই
ওরা পাঠিয়ে দেবে মানচিত্র, নয়তো ফুরিয়ে যাবে সব।
শ্লোক : ১০
আমি বয়ে বেড়াচ্ছি মিঠাইয়ের বোঝা, কাঁধের ওপর
আলগা হয়ে গিয়েছে তার বাঁধন। ভুল পথে হেঁটে হেঁটে
নষ্ট করেছি সারাটি দিন, কী করব কী? হারিয়ে গিয়েছি আমি।
আমাকে চাবুকের মতো আঘাত করছে গুরুর নির্দেশ।
রাখালবিহীন এই পশুর দল, এখন কী হবে?
শ্লোক : ১৩
প্রেমোন্মাদ, আমি, লালা, দিন-রাত আমি
ছুটেছি তাঁর পদচিহ্ন ধরে; ঘুরপথে ফিরে এসে
দেখি, আমার ঘরেই আমার গুরু, হায়
কী ভাগ্য আমার, যাও আলিঙ্গন করো তাঁকে!
শ্লোক : ১৪
নিজেকেই খুঁজতে খুঁজতে নিঃশেষিত আমি।
কেউ তো পারে নি হায়, ভেঙে দিতে গুপ্ত সংকেত।
নিজেকে হারিয়েছিলাম আমি নিজেরই ভেতর,
তারপর খুঁজে পেলাম অমৃত সুধা, অনেক অনেক
পানপাত্রে ভরপুর মদ, অথচ নেই কেউ পান করার।
শ্লোক : ১৫
তোমাকে ‘তোমার’ মোড়কে ঢেকে ‘তোমাকে’ লুকিয়েছিলে
আমার কাছ থেকে; সারাটি দিন তোমাকে খুঁজেছি আমি,
যখন দেখতে পেলাম, ‘তুমি’ লুকিয়ে আছো আমার ভেতর,
তখন উন্মাদ আমি, খেলছি আমার সাথে, ‘তোমার’ সাথে।
শ্লোক : ১৫
চাঁদের খোঁজে আমি বাইরে বেরিয়েছিলাম,
দেখতে বেরিয়েছিলাম আলোর দিকে উড়ে যাচ্ছে আলো।
সর্বত্র বিরাজমান নারায়ণ! সর্বত্র বিরাজমান নারায়ণ!
প্রভু, হে নারায়ণ, আমাকে তুমি উন্মাদ করে দিয়েছো।
শ্লোক : ১৭
ভবঘুরে, পা চালাও, এগিয়ে যাও!
এখনও তোমার সময় আছে, খুঁজে নাও ‘বন্ধু’কে।
নিজেই বানিয়ে নাও পাখা, উড়ো চলো।
এখনও তোমার সময় আছে, খুঁজে নাও ‘বন্ধু’কে।
শ্লোক : ১৮
বাতাস ভরিয়ে তোলো তোমার হাপর,
কামার তোমাকে যেমন শিখিয়েছেন।
এইভাবে তোমার লোহাকে তুমি বদলে দাও স্বর্ণে।
এখনও সময় আছে, ছুটে যাও ‘বন্ধু’র খোঁজে।
শ্লোক : ১৯
ওঠো হে নারী, সাজাও তোমার নৈবেদ্য।
দেবতাদের জন্যে নিয়ে এসো মদ, মাংস, ভোগ।
যদি তুমি জানো ‘মহান মন্দিরে’ প্রবেশের গোপন সংকেত,
তবে তুমি সূত্র ভেঙে পৌঁছুতে পারবে প্রজ্ঞার চূড়ায়।
শ্লোক : ২৫
প্রভু! সত্যিই জানি না আমি — কে আমি, অথবা কে ‘তুমি’।
পোকায় খাওয়া মৃতদেহের ওপর ছুড়ে দিয়েছি আমার প্রেম,
কখনো করি নি হিসেব : ‘তুমি’ই আমি, আমিই ‘তুমি’।
যা-কিছু করেছি আমি, করেছি দ্বিধায় : কে আমি? কে ‘তুমি’?
শ্লোক : ৩১
আমি এক সাধুকে দেখেছি মৃত্যু পর্যন্ত উপবাস করতে,
শীতের বাতাসে একটি পাতাকে উড়ে যেতে দেখেছি
মাটির দিকে, এক আহম্মককে দেখেছি তার রাঁধুনিকে মারতে।
আর আমি এখন এমন একজনের অপেক্ষা করছি যে কিনা
কেটে ফেলতে পারবে প্রেমের সুতো — যা দিয়ে আমি
বাঁধা পড়ে আছি এই উন্মাদ এই পৃথিবীর সঙ্গে।
শ্লোক : ৩২
আমি এখন দেখতে পাচ্ছি ছুটন্ত জলের ধারা,
বন্যায় ডুবিয়ে দিয়েছে সব সাঁকো,
আমি এখন দেখতে পাচ্ছি ফুলে ফুলে জ্বলে ওঠা ঝোঁপ,
দেখতে পাচ্ছি শাখা-প্রশাখার একটি শূন্য কঙ্কাল।