মুকুলের বউ সমাচার

ছবিসূত্র : অনলাইন

মুকুল পালের বউয়ের ব্যাপারটা বলতেই হয়; কারণ বিষয়টা রাশেদের ফ্যান্টাসির ভেতর ঢুকে ইতিহাসের আঁঠালো পাতায় আটকে সটান দলিল দস্তাবেজের হিজিবিজি কালো অক্ষরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বিশেষত ওর বাবা মারা যাবার পর দলিলের মেটে রঙের স্মৃতির মতো বেরিয়ে এলো মুকুল পালের বউ। তাই, না বলে উপায় নেই; না ভেবে উপায় নেই; দলিলের হিজিবিজি অক্ষরগুলো হৃদয় খুঁড়ে ডাকছে, আয়, আয়, আয়…

মুকুল পালের বউ। সিঁথির ভাঁজে, মাঝখানে বয়ে চলেছে সিঁদুরের রক্তিম নদী — টকটকে লাল। লালটিপ। অনিন্দ্য আর্য রমণী। প্রতিমা যেন — যা দেবী সর্ব্বভূতেষু… জিভ বেরুলেই কালী, না বেরুলে দুর্গা, বীণা বাজালেই সরস্বতী। লক্ষ্মী সে হতে পারেনি। তাহলে মুকুল পালের টাকা-পয়সা থাকত, নিউমার্কেটের পুকুর পাড়ে টং দোকানে বসে রুটি বেচতে হতো না; সেই ভোর বেলায় যাও, রুটি বেলো, দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাতে, কাকলি-পদ্মা-রূপকথা-সত্যবতী হলের নাইট শো ভাঙার পর সিনেমাফেরত লোকদের পেছন পেছন বাড়ি ফেরো। এই এক চক্রের ভেতর আটকে যেত না মুকুল পালের রাত-দিন। আর ততক্ষণে পরিতোষ মোদকও সময়-অসময়ে মুকুল পালের বউয়ের কোলে মাথা রেখে… 

তার আগে বলা ভালো, দলিলের সঙ্গে সম্পর্ক কী? জবাব প্রধানত একটাই — বেচা ও বিক্রির। দাগ-নকশা-খতিয়ানের মাথামুণ্ডু  কিছুই বোঝে না রাশেদ। বিএস, আরওআর, বিআরএস — এসব বুঝতে গেলে জমিজমা সংক্রান্ত বইপুস্তক পড়তে হবে দশ খণ্ড। রাশেদের বাবা মরে গেলে ভাগাভাগির ব্যাপারটা এলো আর তখনই পুরনো ট্র্যাংক খুলে বেরিয়ে এলো মেটে রঙের চার-পাঁচটা দলিল।

হাত বদলের ইতিহাস — বসন্তকুমার থেকে বিজয়চন্দ্র, বিজয়চন্দ্র থেকে ফণীভূষণ, ফণীভূষণ থেকে মধু পাল, মধু পাল থেকে মুকুল পাল, মুকুল পাল থেকে পরিতোষ মোদক, পরিতোষ মোদক থেকে মহসীন আলী, ‘অদ্য হইতে আপনি আমার যাবতীয় সত্যে সত্যবান। মালিক দখলকার হইয়া মালিক সরকারের দেয় রাজস্বাদি যথারীতি আদায় পরম সুখে ভোগদখল ও তছরুপ করিতে রহেন। তাহাতে আমি কিংবা আমার ওয়ারীশানগণের কাহারও কোনো দাবি দাওয়া নাই।’ 

সারা দিন ভূমি অফিস, পৌরসভা, উকিলের দপ্তরে ঘুরে বেড়িয়ে হাতে পেল বাগবাড়ী মহল্লার বিশাল এক পর্চা। রাশেদ জীবনে কখনো মহল্লার মানচিত্র দেখেনি। গুগল ম্যাপে একবার দেখেছিল, তাও কেবল মেয়েকে বাড়ি চেনাতে গিয়ে। আজ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে উল্টেপাল্টে দেখল, ‘আরে আরে এখানেই তো আমাদের বাড়ি, বাড়ির পাশে মন্দির, এখানে একটা শিমুল গাছ ছিল, পূর্ব দিকে নীরদের পুকুর, আরও পূর্বে যেখানে অটো রাইস মিল, সেখানে ছিল নীরদের ভিটা, আরও পূর্বে নীরদের বাড়ির ওপর এখন একটা মাদ্রাসা, মাদ্রাসার পাশে বিশাল সেই বিল, প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা, ঘুড়ি ওড়াবার মাঠ… ধানক্ষেত… বিলের ওই পারে ধু-ধু জমির ওপর দিয়ে একটা রাস্তা…’ রাশেদ ভাবত রাস্তাটা কোথায় গিয়ে মিশেছে! 

মধু পালের জায়গা কিনে রাশেদের বাবা বাড়ি বানিয়েছে ১৯৮০ সালে। তুলসীতলায় জল আর রক্ত গড়িয়ে সেও তো অনেক দিন। এরশাদ যখন ক্ষমতায়, দলে দলে হিন্দুরা যখন ওই পারে যাচ্ছিল, রাশেদ তখন শিশু, কিশোর অথবা বালক। সে সময়, কোনো একদিন আচমকাই হয়তোবা শংকরদা নেই। চলে গেছে। সুবলদা নেই, চলে গেছে। সুমন্তদা নেই, চলে গেছে। জিজ্ঞেস করলে কাকিমা হয়তো বলে, ‘কলকাতা মাসির বাড়ি গেছে। আইবো…’ তারপর হয়তো ‘ডাইলের বড়ি শুকাইছে কিনা দ্যাখতো পাপড়ি’ বলে কাকিমা সরে যান। অনেক অনেক দিন পর হয়তোবা রাশেদ শুনতে পায় নিতাইয়ের কাছে, ‘দাদায় তো দিল্লি গেছে গা, দোকানে কাম করে।’

‘কীসের দোকান?’

‘ওষুদের।’

‘অনিল কাপুররে দেখছে বোধ হয়!’

‘কী জানি! কাউরে কইস না…’

‘আচ্ছা, কমুনা…’

‘শ্রীদেবীরে দেখছে বোধ হয়…’

‘দেখতে পারে… কাউরে কইস না কিন্তু দাদায় যে দিল্লি গেছেগা… মা বকবো!’

‘আচ্ছা, কমুনা। ডরাস ক্যা?’

‘ডরাই না।’

‘তাইলে?’

‘এমনেই…’ 

মন্টু ড্রাইভারের বাড়ি-ভিটা, পুকুর, জমি সব যখন বাকি সাহেব দখল নিতে এল তখন জানা গেল বেচাবিক্রি করে মন্টু ড্রাইভাররা চলে গেছে। আর আসবে না। রাশেদ বোঝে না। শুধু শোনে, চলে যায়, চলে যাচ্ছে, আসে না, আসবে না। 

ওরই মধ্যে পৌষের এক রাতে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে রাশেদের ঘুম ভাঙে। তখনোও ইলেকট্রিসিটি আসেনি পাড়ায়। হ্যারিকেনের আলোয় বাবার সঙ্গে পা টিপে টিপে বের হয়। মুকুল পালের বাড়ির সামনে ভিড়। কুপি বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে রমেন কাকা, পরেশ কাকা, হিমাংশু কাকা – আরও কারা কারা যেন। 

‘কী মুশকিলের কথা কও তো..!’ — রমেন কাকা বলে।

‘কী করমু আমি, তুমরাই কও! আইজ বেড়া কাটছে, কাইল ঢিল মারছে, পরশু কী করব তার আন্দাজও তো করবার পারি না।’ – মুকুল পাল বলে। 

হিমাংশু কাকার চোখে সব সময় ভয় লেগে থাকে। রাশেদ এখনও সেই হিম লাগা ভয়ের মুখ দেখতে পায়। চির কালের ফিসফিসানো গলায় বলে, ‘থাক। এত কথার কাম নাই।’ অন্ধকারের আড়ালে পাড়ার বউঝিরা মুখ লুকিয়ে আছে। আর ফিসফিস। ফিসফিস। যেন শুনে ফেলবে কেউ। শুনে ফেললেই বিপদ।

রাশেদের বাবা মহসিন আলী ভেবেছিলেন ডাকাত। কিন্তু চোর বা ডাকাত না। ইঙ্গিত অন্য কোথাও। রাশেদ বোঝে অথবা বোঝে না। পরদিন নিতাই অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছিল। মুকুল পালের ঘরে কী আছে রে! রুটি বেচে খায়। যা অছে, তার দিকেই হাত পড়েছিল। ওই রাতেই যে যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল। নিতাই এও বলেছিল, দেখিস তো পরিতোষ কাকা কী করে! 

কী করে? সে তো কেবল মাথাই রাখে মুকুল কাকার বউয়ের কোলে। নিতাই বিড়ি ফুকতে ফুকতে হাসে, ‘তোর বউ আমারে দিবি?’ অদ্ভুত একটা ছেলে। কী কী যে করে! বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল দু’বার। কী বলতে কী বলে বোঝা মুশকিল; কিন্তু পৌষ রাতের ঘটনার সঙ্গে পরিতোষের কী সম্পর্ক? ‘শালা, মাল বুঝস, মাল! মাল একটা…’ – নিতাই হিহি করে হাসে। নিতাইয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল নাসির। ব্লু ফিল্মে দেখেছে, এই রকম মাল। নিতাইয়ের হাসি, ইশারায় রাশেদ ঢুকে পড়ে ফ্যান্টাসির ভেতর। এতদিন তো কাকিই ছিল! কিন্তু মাস্টারবেশনের সময়… সিঁথির সিঁদুর। দু’ভাগ যোনী। পরিতোষ-কাকিমা। কিনু সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নির্মীয়মান প্রতিমার বুকে চুপিচুপি হাত বুলিয়ে নেয় রাশেদ আর নিতাই। এইসব… 

তারই মধ্যে কে যেন বলছে, ‘কাসুন্দি দিয়া আম মাখাইছি, খাবি? খুব মজা।’ কাকিমার সিঁথির সিঁদুর থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে রক্ত।

মাটি রঙের দলিল হাতে আজ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখেও রাশেদ ফিরে যেতে পারছে সেই পৌষের রাতে। মুকুল পালের ভিটার ওপর যে বাড়িটায় বসে আছে ওর বাবা কিনে নিয়েছে ১৯৯৪-এ। ঘুমে ঢুলুঢুলু রাশেদ চোখ খোলা রেখেও দেখতে পাচ্ছে বাড়ির মাঝখানটায় ছিল তুলসীতলা, পুকুরের ঘাটলার কাছে ছিল শিউলি গাছ, পাড়জুড়ে ছিল নারিকেল গাছের সারি, সুপারি গাছগুলো অমিতাভ বচ্চনের মতো করে টানটান মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কুলি সিনেমায় যেমন টান টান করে গান গেয়েছিল, ‘সারি দুনিয়াকা বোজ হাম উঠাতে হে।’ 

এই খানে বাড়ি বলতে ছিল দুটি টিনের চালা। মাটির ভিটি। বাড়ির আনাচে কানাচে ছিল এলাচি লেবুর গাছ। একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। জ্যৈষ্ঠ মাসে শত শত বানরের মতো ঝুলে থাকত কাঁঠাল। পুকুরটা পরিতোষ মোদকের। আগে ছিল মুকুল পালের বাবা মধু পালের। বিক্রি করতে করতে জমি গিয়ে ঠেকেছিল শেষ ধাপে। অবশিষ্ট ছিল ওই বাড়িভিটা।

সেই কবে কোনো কোনো গভীর রাতে বাঁশের জঙ্গলে ঢুকে যেত মধু পাল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডাকত, ‘আমার ট্যাকাগুলা দিলা না? ও মণ্ডল, আছ নাকি?’ রাশেদের বাবা হয়ত বলত, ‘কাকা, বাড়িত যান গা। এত রাইতে বাইর অইছেন ক্যা।’ 

‘আমার ট্যাকাগুলা। মণ্ডলের কাছে ট্যাকা পাইতাম।’ 

‘কাকা, আমি মহসিন, মণ্ডলের বাড়ি তো এইটা না।’

‘ওহ, মণ্ডলের বাড়ি কই?’

‘কাকা আপনে বাড়িত যান।’

‘ট্যাকাগুলা নিয়া যাই।’

মহসীন আলী জোরে জোরে ডাকে, ‘মুকুল… ঘুমাইছস? কাকা রে নিয়া যা।’ ঘরঘর গলায় মধু পাল বিড় বিড় করে, ‘মুহুরির কাছে পাই দশ হাজার। মন্ডলের কাছে তেরো হাজার।… কত হইল? কও তো? হুম…’ কুঁজো হয়ে যাওয়া লোকটা মহসিন আলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। রাশেদ সেই বিড় বিড় গলা এখনো শুনতে পাচ্ছে।

এই বাড়িতেই সুনসান নীরব দুপুরে পরিতোষ মোদক আসত। বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা সাইকেল দেখেই বোঝা যেত কৃষ্ণ এসে গেছে। গুনগুন করে কাকিমা গাইছেন, ‘বনমালী তুমি, পরজনমে হইও রাধা…’ পরিতোষের মাথা কাকিমার বুকের কাছে, কোলের কাছে। রাশেদ দেখে। নিতাই বোধ হয় হাসছে কোথাও দূর থেকে। ‘পরপুরুষ ঘরে তুলো, লজ্জা-শরমের মাথা খাইছো।’ — চুপিচুপি মাকে বলতে শুনেছিল রাশেদ।

রাশেদের বাবার বন্ধু মুকুল পাল। বার দুই-তিনেক ইন্ডিয়া ঘুরে এসে মুকুল বলল, ‘তুমিই নেও গা। বেইচ্যা দিমু। পারলে কিছু আগাম দিও। দ্যাশের অবস্থা বিশেষ ভালা না। বুঝোই তো। যামুগা।’ বাবরি মসজিদ কা- তখন শেষ। তবে আঁচ তো ছিলই। দশ বারোটা মোটরসাইকেল পাড়ায় ঢুকলে চুল বাঁধতে বসা মেয়ে-বুড়ি-ছুড়িরা দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে যেত। শুকাতে দেওয়া ডালের বড়ি আর বিধবাদের সাদা থানগুলো বাতাসে উড়ত। শূন্য সন্ধ্যায় নিঃসঙ্গ পড়ে থাকত গোল্লাছুটের মাঠ।

পোড়া মাটির মতো লালচে দলিল হাতে রাশেদ সুনসান নীরবতায় পাতা উল্টাতে উল্টাতে এইসব দৃশ্য দেখতে পায়। চৌধুরী বুড়ির একটা গাই ছিল, নাম শুক্লা। কী মায়া-মায়া চোখ।

সেই সন্ধ্যাটা ছিল ভয়াল — যেদিন বাবরি মসজিদে ঘা পড়ল। সিএনএন আর বিবিসি সমান তালে জানান দিল, ‘ভাঙা হচ্ছে।’ পাড়াজুড়ে ভয়। একাত্তরের পর আবার নতুন কোনো ‘গণ্ডগোল’ দেখা দিল। ‘রায়ট’ হবে নাকি। এই শব্দ দুটি রাশেদ তখনই শুনেছে। 

অতএব, মা কালীরও কপাল পুড়ল। কালী মন্দিরে প্রথম আঘাতটা যে দিয়েছিল সে ছিল বেশ্যার দালাল। কী যেন নাম? হাসমত? হাবা হাসমত বলত লোকে। অবশ্য হাবা ছিল না। কে জানত মন্দির ভাঙার এক বছর পরে পালবাড়ির জোতজমি যখন মহসীন আলীদের হাতে, তখন বাপ-বেটা মিলে অথবা আলাদা আলাদাভাবে অথবা বন্ধুদের নিয়ে সেই জংলা বাড়ির ঝোঁপঝাড়ের মাঝখানে প্রতিদিন সকালে দেখতে পাবে লাল লাল কন্ডম! আর এইসবের হোতা তো সেই-ই, যে কিনা মসজিদেও যাবে না, আবার মন্দিরও ভাঙবে, আবার আলেয়া অথবা আকিলাকে নিয়ে পালবাড়ি ওরফে মহসীন আলীর জংলি ভিটায় রাতবিরাতে পাটি বিছিয়ে শোবেও।

পোড়া মাটির মতো লালচে দলিল হাতে রাশেদ সুনসান নীরবতায় পাতা উল্টাতে উল্টাতে এইসব দৃশ্য দেখতে পায়। চৌধুরী বুড়ির একটা গাই ছিল, নাম শুক্লা। কী মায়া-মায়া চোখ। প্রথম বিয়োবার পর এক গ্লাস দুধ রাশেদকে দিয়েছিল বুড়ি। অথচ বুড়ি ছিল হাড়কিপটা। সব কুল মিলিয়ে বুড়ির মানুষ মূলত একটিই- ছেলেটা। বাবরি মসজিদ কাণ্ডের পর পর একবার এলো। কালোর মতোন, লম্বা লোকটা। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় কাজ করে। কিছু দিন পর আবার এলো। বুড়ি শুক্লার মেয়ে সতীকে রেখে ডুকরে ডুকরে কেঁদে চলে গেল। কাঁসার গ্লাসের দুধগন্ধ স্বাদ রাশেদের জিভের ডগায় স্মৃতি হয়ে হানা দিচ্ছে।

আহা, নেপালি বৌদির কথা না ভাবলেই নয়। মনীষা কৈরালা। রাশেদ আজ পর্যন্ত জানে না, নাম কি বৌদির। সুমন্তদার বউ; কিন্তু নেপাল মানে তো তখন মনীষা কৈরালাই। তার বাইরে আর কোনো নেপালি নাম জানা নেই। তাই বৌদি আর মনীষা কৈরালা এক হয়ে গেছে। এখন না হয় নেপাল মানে খানিকটা মাওবাদ, দরিদ্র রাষ্ট্র, ভূমিকম্প আর ইউএস বাংলার বিমান ধসে পড়া। তখন তো সেই মনীষা কৈরালাই। ’৯৪-এর দিকে বোধ ওরা এলো। মাস ছয়েক অথবা বছর খানেক থাকল। তারপর আবার হাওয়া। অনেক অনেক দিন পর কান্নার রোল শুনে জানা গেল ইন্ডিয়া থেকে চিঠি এসেছে — সুমন্তদা মারা গেছে। 

মুকুল পালেরা তখন নেই। চলে গেছে। কোথায়? কয়টা শহরের নাম জানত রাশেদ? আঙুলের কর গুনে দেখত- হুগলি? হাওড়া? কলকাতা? বারাসাত? দিল্লি? বোম্বে? মনে পড়ে ওপার থেকে এপারে এসে কে একজন বলেছিল পালেরা ভালো নেই। মুকুলের হাঁপানির রোগ। বউটা ভেগে গেছে। কই গেছে, কে জানে। বউটা নিঃসন্তান ছিল। রাশেদকে ডেকে বলত, ‘শুক্ত খাবি?’

‘শুক্ত কী কাকি?’

‘খায়া দ্যাখ।’

‘কাসুন্দি দিয়া আম মাখাইছি, খুব মজা। খাবি?’

কুয়াশার ভেতরে চাঁদ। ঠাণ্ডা পড়েছে খুব। জমে যাওয়া চাঁদের খানিকটা ঝুলে আছে পালবাড়ির পুরনো সুপারি গাছটার কাছে। হয়তো এমন কত কত রাত পেরিয়ে গেছে যে রাতগুলো অতীত অতীত এবং অতীত — হিসেবের বাইরে। পাল বাড়ির জোত জমির শেষ মালিকানার একজন শরিক রাশেদ। বাড়ির চারপাশটা দ্যাখে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে!

মাঝরাতে ঘুম ভাঙে। মনে হয়, ছাদের কার্নিশে দেয়ালে উঠানে ছায়া-ছায়া সুপারি গাছের তলায় পুকুর ঘাটে হেঁটে বেড়াচ্ছে মধু পাল, অথবা মুকুল পাল, কিংবা সেই বসন্তকুমার। দূর থেকে নিতাইয়ের রহস্যময় হাসি — হা-হা-হি-হি। ও হ্যাঁ, নিতাইও চলে গেছে ওই পাড়ে। কবে যে গেছে, বলেও যায়নি। তারই মধ্যে কে যেন বলছে, ‘কাসুন্দি দিয়া আম মাখাইছি, খাবি? খুব মজা।’ কাকিমার সিঁথির সিঁদুর থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে রক্ত।

প্রথম প্রকাশ : প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২০, সাম্প্রতিক দেশকাল

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Prev
আবুল হাসনাত : সামান্য স্মৃতি

আবুল হাসনাত : সামান্য স্মৃতি

সদ্য প্রয়াত কবি, গদ্যকার ও সাহিত্য সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার

Next
ছন্দের শহরে একদিন

ছন্দের শহরে একদিন

ছন্দবদ্ধ কবিতা নিয়ে অনেকের দ্বিধা, সংকোচ ও অবজ্ঞা। আমি ছন্দ ভালোবাসি, যেমন

Total
0
Share