‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’- বাংলা লোকগানের কথা। জলে ডুবুক আর না-ই ডুবুক, ডুবে ডুবে জল খেতে লোকের আপত্তি খুব কমই। তাই প্রেমবন্দনার কমতি নেই কোনো মুলুকে। মহাভারতের মহা আখ্যানে থরে থরে সাজানো আছে প্রেম-উপাখ্যান। আবার ট্রয় পুড়ে খাক হওয়ার কারণও প্রেম।
বাংলা ভাষায় অতি পুরনো শব্দের একটি প্রেম, যেটিতে মরচে পড়েনি। সামান্য দাগ পড়লেও খানিকটা ঘষামাজা করে কেউ-না-কেউ নতুনভাবে ঝকঝকে তকতকে করে তুলেছে শব্দটিকে। সে কারণে আমরা এখনও প্রেমে পড়ি, প্রেম করি। মাঝে মাঝে ভেঙে যায় আমাদের অমর ‘অনন্ত প্রেম’। এ কালে অবশ্য আমরা ‘বয় ফ্রেন্ড/গার্ল ফ্রেন্ডকে অনেক ষড়াব করি’। কিংবা ফরাশি ফিয়াসেঁ বা ইংরেজি অ্যাফেয়ারের সঙ্গে অভিসারের বদলে আমরা ডেটিঙে যাই। কিন্তু প্রেম শব্দটির সঙ্গে এখনও একশোতে একশো ভাগ ‘ব্রেইক আপ’ ঘটে নি বাংলাভাষীদের। আর তাই বাঙালির প্রেম-পীরিতের দিকে আমরা একটু তাকাতে চাই।
প্রেমের সঙ্গে প্রিয়র সম্পর্ক কেবল মানসিক বা দৈহিকই নয়, ব্যাকরণিকও। প্রিয় ও ইমন যুক্ত হয়ে প্রেমবন্ধনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে প্রেম। এখানে ইমন একটি প্রত্যয়। বলাবাহুল্য, প্রেম একটি সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত প্রেমা, প্রেমাণ থেকে প্রেম; কিন্তু প্রেম হবার জন্য তো ‘প্রিয়’ হওয়া চাই। তাই সংস্কৃতে আছে প্রী; এই প্রী থেকে প্রেম সম্পর্কিত যাবতীয় প্রী-যুক্ত শব্দের উৎপত্তি।
প্রী মহাশয়/মহাশয়ার রাশারাশি অর্থ করেছেন সংস্কৃত ভাষাবিদ মনিয়ের উইলিয়ামস। যেমন : আনন্দিত করা, উৎফুল্ল করা, উল্লাস করা। আবার আনন্দিত বা তৃপ্ত হওয়া। কিংবা পছন্দ করা, ভালোবাসা, দয়ালু হওয়া। প্রী থেকেই প্রিয়, প্রিয়ম, প্রিয়া, প্রেয়স, প্রেয়সী; এমনকি বলিউড-নন্দিনী প্রিয়াংকা চোপড়ার প্রিয়াংকাটুকুও প্রী থেকে আসা। আরও আছে : প্রিয়তি, প্রীত, প্রীতি। সংস্কৃতে যা প্রেম ও প্রীতি, পালি ভাষায় তা-ই পেম ও পীতি; আঞ্চলিক বাংলা উচ্চারণে দুটিই আছে কোথাও কোথাও। বিশেষ করে ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাওয়া যাবেই যাবে। প্রীতি ভেঙে পরবর্তীকালে তৈরি হয়েছে পিরিতি বা পীরিতি।
‘এমন পীরিতি কভু নাহি দেখি শুনি/পরাণে পরাণ বান্ধা আপনা আপনি।’- এ লেখা মধ্যযুগের। অথচ এখনো আছে পীরিত শব্দটি। পাবেন কোথায়? সাধারণ আলাপে, লোকগানে। যেমন : পীরিতের আলাপ বাদ দাও। কিংবা ওর সঙ্গে তো তোমার অনেক পীরিত। মান-বাংলাসেবী অনেকে মনে করতে পারেন প্রেমের ভেতরকার স্নিগ্ধ ভাবটি পীরিতে এসে পীড়িত হয়ে পড়ে। তাই বলতে পারেন, পীরিতি স্ল্যাং বা অশিষ্ট বচন। কারণ পীরিতের একটি লৌকিক অর্থ হলো : অবৈধ প্রেম; মান-বাংলাসেবীরা হয়তো তার বদলে বলবেন পরকীয়া।
স্বকীয়র বিপরীতে পরকীয় থেকে পরকীয়া। নিজের প্রতি যে প্রেম সেটি স্বকীয় প্রেম, আত্মপ্রেম; পরের প্রতি যে প্রেম সে প্রেম পরকীয়া! তাই বলে কি পীরিতের দীর্ঘশ্বাস কম? মোটেও না; যেমন : ‘পীরিতি শিখাইলা রে বন্ধু/ চলে যাইবার কালে।’ পরকীয় প্রণয়ে দীর্ঘশ্বাস মথিত বিরহ যদি না-ই থাকত তাহলে কি পরম্পরা ধরে প্রবাহিত হতো রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমাকুতি? ভারতীয় প্রেমের দুই ভাব : রাধাভাব ও কৃষ্ণভাব হারিয়ে যেত সেই কবেই। প্রাচীন বাংলায় প্রেমের সমার্থক শব্দ রূপে ছিল নেহা। সংস্কৃত স্নেহ ভেঙে নেহ, নেহা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধা বলছে :
ঘরের স্বামী মোর সর্বাঙ্গে সুন্দর
আছে সুলক্ষণ দেহা।
নান্দের ঘরের গরু রাখোআল
তা সমে কি মোর নেহা ॥
সরল বঙ্গীয় অর্থ এই : আমার ঘরে আছে সর্বাঙ্গসুন্দর স্বামী, সুলক্ষণ তার দেহ; আর নান্দের ঘরের গরুর রাখাল তার সঙ্গে কিনা আমার প্রেম! পরবর্তী কালে নপুংসক স্বামীকে নিয়ে রাধার বড়াই কৃষ্ণ-আলিঙ্গনে মিলিয়ে যায়। স্নেহ সাধারণত নিম্নগামী, হয়তো তা-ই রাধিকা ঝুঁকে পড়েছিল বয়সে কনিষ্ঠ কৃষ্ণের দিকে। যাই হোক, সমকালীন বাংলায় স্নেহ বলতে বোঝায় বয়সে ছোটদের প্রতি বড়দের মমতা ও ভালোবাসা।
আসলে প্রেমামৃত পানে বাঙালি কখনোই পিছু হটেনি; মন-বৃন্দাবনে তাই রাধা ও কৃষ্ণের সতত সমাগম। স্বকীয়-পরকীয়-নিষ্ক্রিয় সকল ধরনের প্রেম-সংঘটনে বাঙালি পারদর্শী। কবি বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন, ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’ আমাদের গ্রহণ-সক্ষমতা প্রমাণ করে ভালোবাসা শব্দটির চলতি অর্থ গ্রহণ ও নির্মাণ।
ভালোবাসা শব্দটিকে কীভাবে বানিয়ে নিয়েছে, দেখুন : সংস্কৃত ভদ্র, প্রাকৃত ভল্ল, বাংলা ভালো; ভালোর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে ‘বাসনা’র বাসা- বাসা-বাড়ি নয়। সংস্কৃত বশ বলতে বোঝায় ইচ্ছা করা। বশ থেকে বাসনা। বাসনার বাংলা রূপ বাসা। ভালোবাসার অর্থ তৈরি হলো- ভালো ইচ্ছা করা। তাই, কেউ যদি বলেন, ‘আমি তোমাকে মন্দবাসি’, তাকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে না। বাংলায় ভালোবাসা এখন ইংরেজি লাভ বা প্রেমের বিকল্প সমার্থক শব্দ।
বাঙালির ভালোবাসায় পারদর্শিতা কেবল সংস্কৃতের হাত ধরে আসেনি। বাঙালি তার প্রেমের সঙ্গে প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ইশক বা এশক, মহব্বত, পিয়ার বা পেয়ার ও লাভের। এতে করে লোকসান হয়নি, বরং লাভই হয়েছে। বাংলা ভাষায় শব্দ বেড়েছে, প্রয়োগের বৈচিত্র্য বেড়েছে।
আরবি এশক থেকে হয়েছে ইশক বা এশক। প্রেমে মত্ত ব্যক্তিকে আমরা বলি, ‘এসকে দিওয়ানা’। নজরুল লিখেছেন, ‘আন্ধা ইশক ম্যারা কাস গ্যয়ি।’ মহব্বতের উৎস আরবি মুহব্বত। প্রয়োজন পড়লেই বলি, ‘এত মহব্বত, এত খাতির, তবুও খাতিরের পাতিল ভাঙল!’ অন্য দিকে ধারণা করা হয়, সংস্কৃত শব্দ প্রিয় ভেঙে এসেছে পিয়ার বা পেয়ার। হিন্দি ও উর্দুতে ইশক, মহব্বত ও পিয়ার তিনটিই প্রচুর ব্যবহৃত হয়; হিন্দি-উর্দু গান ও কবিতা অসম্পূর্ণ থেকে যায় ওই তিনটি শব্দের যে কোনো একটির অনুপস্থিতিতে। মির তকি মির যেমন লিখেছিলেন :
ইবতেদা এ ইশকমে রোহা হ্যায় ক্যায়া।
আগে আগে দেখিয়ে হোতা হ্যায় ক্যায়া ॥
সবে তো প্রেমের শুরু, এখনই কাঁদছ? দ্যাখো সামনে আরও কত কী ঘটে! ঘটে যে, তা মির্জা গালিবও টের পেয়েছিলেন হাড়ে হাড়ে। তাই লিখেছিলেন :
মহাব্বত মে নেহি হ্যায় ফারক জীনে অওর মরনে কা।
উসি কো দেখ কার জীতে হ্যাঁ জিস কাফির পে দম নিকলে ॥
‘যাব পেয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া।’ কিন্তু প্রচলিত শিষ্ট ভাষায় এসব শব্দের প্রয়োগে বাঙালি ‘ডার গিয়া’। অবশ্য আঞ্চলিক বাংলায় এসবের প্রয়োগ ভালোই চলে।
ওই দিকে আমরা পড়তে শিখেছি : ‘লাভ ইজ আ রেড রোজ।’ ইংরেজি Love শব্দটি এসেছে অনেক পুরনো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার leubh থেকে। লাভের সমতুল্য হিসেবে জার্মান ভাষায় আছে lieve। ইংরেজি লাভের সঙ্গে নবষরবাব এরও যোগসূত্র আছে। প্রেমে তো একটু-আধটু বিশ্বাসও চাই! অন্য দিকে লাতিনে আছে libido-অদম্য বাসনা। এর সঙ্গেও জাড়িয়ে আছে সংস্কৃত প্রী-এর মতো পরিতৃপ্ত হবার তীব্র ব্যাকুলতা।
সত্যি কথা বলতে কি, বাসনার বিরাট এক অংশ প্রেম। যৌনমনস্তত্ত্বের বিশ্বপুরোহিত সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ভাবনাচিন্তা বুঝে-না-বুঝে আমরা যারা পেন্সিলকে পেনিস আর ফুটো-মাত্রই ভ্যাজাইনা ভেবে নিতে অভ্যস্ত তাদের কাছে লিবিডো ও লাভে কোনো তফাত নেই। ক্ষতির বদলে দুটিতেই তাদের সমান লাভ। আমি জানি প্লাটোনিকরা বলবেন ভিন্ন কথা। তারা বলবেন কামগন্ধ বর্জিত দেহাতিরিক্ত প্রেমের কথা। যেমন বলেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ,
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে কহি কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম ॥
উর্দুতে একেই বলে ‘ইশক-এ-হাকীকী’; শরীরী প্রেমকে বলা হয়, ‘ইশক-এ-মজাজি’; তো, থাকুক না দুই প্রেম- কে কার পাতে ভাগ বসাতে যাচ্ছে!