পতনের শব্দ সত্য, তবু যেতে হবে বহু দূর

কবি সুমন সাজ্জাদের প্রথম কবিতার বই পতনের শব্দগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ এর মধ্যে নিহিত কাব্যধর্মের জন্যেই। অজস্র পথের মোহনায় দাঁড়িয়ে-থাকা পথিকের মতো হতচকিত নন এই তরুণ কবি। কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায়, পাঠককে চমকে দেয়ার ইচ্ছে নেই তার, শক্তিমদ-মত্ত দৈত্যের মতো ভাঙচুরও তাঁর অভীষ্ট নয়। কষ্ট-কল্পনার প্রশ্রয় নেই, জবিরদস্তির চিহ্ন নেই। খুবই আন্তরিক ও প্রাণবন্ত একটি আবহ নির্মাণ করে তাঁর কবিতা। পরিণত মনের যে পরিচয় এর মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে, তা বিস্মিতও করে, অন্তত আমাকে। স্পর্ধা তারুণ্যের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি বলে অনেক তরুণ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থে অস্থিরতা, চিত্তচাঞ্চল্য ও সিদ্ধান্তহীনতার অসহায়ত্ব মুখ্য উপকরণ হয়ে ওঠে। সুমনকে মনে হয় স্থিতধী। বোঝা যায়, কবিতা বিষয়ক দু-চারটে প্রবন্ধ তাঁর, যা পড়েছি, তা যতটা বাহ্যিক প্ররোচনায় উত্তেজিত, কবিতা ততটা নয়। এ দুটি প্রবাহ সর্বসম বা সমান্তরাল হলে সুমন সাজ্জাদের কাছে কবি হিসেবে প্রত্যাশার কিছু থাকত না। তখন হয়তো তাঁর রচনায় মানব-কেন্দ্রিক অনুভূতির অন্তর্লিপ্তির চেয়ে প্যারাডাইম বদলের কৃত্রিম প্রয়াস প্রধান হয়ে উঠত। পাণ্ডিত্যের ডামাডোলে ক্ষতি হত কবিতার।
সুমনের কবিতায় ব্যক্তি-মানুষের আনন্দ-বেদনা, স্বদেশের স্বপ্নিল মুখচ্ছবি, আমাদের সামাজিক বিবর্তনের পরম্পরা খুব নির্ভার এক বাক্যবিন্যাসে উপস্থাপিত হয় :
বিষ্ণুপুরের সবুজ মাটি আজ লাল হলো;
লাল-মাটি পাহাড়ের সবুজ পল্লবে লেগেছে
আগুন, এই আগুন আজ থামাবে কে?
(‘বিষ্ণুপুর’)
বা,
তাদের নৈবেদ্য-ভরা প্রেম-পদাবলি গড়ে তোলে
সহজ কীর্তন, তাই তো ফিরে আসা, মাটির মৃদঙ্গ হয়ে
বেজে চলা সারা দুপুর, দেহে তাই মহুয়ামদির ঘ্রাণ।
(‘বোধিবৃক্ষ’)
বা,
শহরের বৃষ্টিতে আমরা পেয়ে গেছি আঠারো টুকরো
লাশের সৌরভ; শববাহী গাড়ি তুলে নিয়ে গেলো
মাংসের স্তবক। আমরা হাঁটছি। ট্রাফিক সিগনালের
লাল-সবুজ আলোর সঙ্কেত কাঁদছে; যেহেতু সে
দেখে ফেলেছে মানুষের মৃত্যুমুখি চোখের ক্রন্দন।
(‘আরশিনগর’)
এই সহজ ও নির্ভার রূপায়ণ স্বতঃস্ফূর্ততার স্বাদবহ হলেও, এর মধ্যে যে ধারাবাহিক পরিচর্যার নেপথ্য-ইতিহাস আছে, সচেতন পাঠক তা বুঝতে পারবেন তার শব্দ-ছন্দ ব্যবহারের প্রবণতা থেকে। তত্ত্ব-তাড়িত কবির মতোই হয়তো তিনি উত্তরাধুনিক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গকে চেতনায় লালন করেন, কিন্তু তিনি যখন তাঁর কবিতায় আমাদের লোকজ বা মধ্যযুগের সাহিত্যের কোনো চরিত্র বা প্রসঙ্গানুপুঙ্খকে গ্রন্থিত করে দেন, তখন তা অভিজ্ঞতা ও সংবেদনশীলতার তীব্রতায় স্বাভাবিক বা প্রাকৃত একটি আবহ রচনা করে, যা দুর্লভ বলেই প্রত্যাশিত। এবং প্রশংসনীয়।
জলেশ্বরী জাগো, অনন্ত চন্দ্রের ঘাণে সব পাখি
ফিরে এসে আবারও বেঁধেছে ঘর, জলশোভা
নদীর কিনারে দেখ সূর্য ও চন্দ্রের গার্হস্থসন্ন্যাস…
(‘গার্হস্থসন্ন্যাস’)
বা,

আষাঢ়ের প্রথম দিবসে মেঘদূতের প্রাচীন পুঁথির
মৃত সব অক্ষর থেকে ঝরে পড়ে নীলনবঘন মেঘ।

বা,
একদিকে উদয় রে ভানু চৌদিকে পসর;
এরই মধ্যে রঙিন সূর্যের দিকে মুখ রেখে
তুমি যাবে পুবে ও পশ্চিমে; আর আমি ঘর
ছেড়ে একটি সূর্যিত মুখ দেখবো বলে এক বেঁকে

চলে যাবো উত্তরে-দক্ষিণে, …
(‘মেঘরাজের ভ্রমণবার্তা’)
অর্থাৎ, ঘর তাকে টানে, সন্ন্যাসও। বাস্তব অর্থে, রূপকার্থেও। যদি সংকট বলি, এ সংকটকে তিনি স্বীকার করেন, সাফারও করেন, বিস্ময়কর যে, এ থেকে পরিত্রাণের কোনো চেষ্টা তিনি করেন না। বৈপরীত্যময় নানাবিধ স্বপ্ন-কল্পনা-বাস্তবতার মোহে-সম্মোহে তিনি আবর্তিত হতে থাকেন, এবং এই আবর্তন ক্রমাগত সম্প্রসারিত হতে থাকে, তার আভ্যন্তর-বর্ণমালা বদলে বদলে যায়, বদলায় চাপ-তাপ, শিহরিত অনুভূতিপুঞ্জ।

বর্তমান তার অপ্রিয় নয়, তবে অতিক্রান্ত কালপর্বই তার আশ্রয়। কেবল আশ্রয় নয়, উজ্জীবনের, উৎসারণের, ঔজ্জ্বল্যের উৎসও বটে। এই প্রবণতা কাব্যচেতনাকেও আচ্ছন্ন করে রাখে, তাই চর্যার রচয়িতা, মধ্যযুগের কবি, লোকসাহিত্যের স্রষ্টা জ্ঞাত-অজ্ঞাত মানুষের প্রতি তিনি প্রণত। এই কৃতজ্ঞতার বোধ কখনো কখনো দেশোত্তর। গালিবের প্রতি বিশেষভাবেই আসক্ত। গজলের নেশাচ্ছন্ন বিষয় ও ভাষাশৈলী, প্রকারান্তরে যা তীব্র জীবনাসক্তির নামান্তর — প্রকৃতি-নারী-ঈশ্বরের সম্পর্কের জটিল ও ঘোলাটে রহস্য-মাধুর্য — তাঁর কবিতায় পুষ্টির জোগান দেয়। গভীর জীবন-দর্শন ও প্রগাঢ় উচ্চারণজনিত এই সম্পর্ক কবি সুমন সাজ্জাদের বিবেচিত শিল্পচেতনার পরিচয়কে স্পষ্ট করে তুলেছে। এতে আত্ম-আস্থা ও শক্তিমত্তার ইশারাও রয়েছে। চর্যাপদের স্রষ্টাদের তিনি তাঁর কাব্য উৎসর্গ করেই কেবল ঐতিহ্য-লগ্নতার পরিচয় দেননি, তাঁদের রচনার উদ্ভাসনকেও স্বীয় বোধের অনুসঙ্গী হিসেবে আত্তীকৃত করতে সমর্থ হয়েছেন:
দেহ হলো সুন্দর তরু
তাঁর পাঁচটি শাখা সেই শাখায় ভর করেছে
অনন্ত কাল, লাফ দিয়েছে
পাঁচ তরুণীর প্রেম

দেহ হলো সুন্দর তরু
শাখায় শাখায় সুন্দর ফুল।
(‘তরু’)
এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, যখন তরুণ কবিদের মধ্যে ছন্দ-অনীহা প্রকট। এর পক্ষে নানাবিধ ব্যাখ্যা তাদের আছে, কিন্তু ছন্দের বন্ধনে বন্দি হয়ে পড়ার ভয়টাকেই এই অনীহা, প্রকৃতপক্ষে ভীতি হয়তোবা, অন্তত অনেক ক্ষেত্রে, আমার মুখ্য কারণ মনে হয়। সুমন এ ক্ষেত্রেও পরিণত বোধের পরিচয় দিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন, ছন্দ ও গদ্যের সমবায়ে সৃষ্ট তার কাব্যভাষা সামর্থ্যসম্পন্ন। কোথাও ছন্দ তাকে পরাস্ত করেনি, সর্বত্র আনুগত্য করেছে। ছন্দের মতো গীতলতাকেও তিনি অনর্থক পাশ কাটিয়ে যাননি। যে ভূ-সংস্থানে, যে জলবায়ুতে, যে-সংস্কুতিতে আমার উন্মেষ, বিকাশ ও সামনে এগিয়ে যাওয়া, সেই পরিপ্রেক্ষিতকে মনে রাখলে, বাংলা কবিতার সঙ্গে এই গীতলতার সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য, তা অস্বীকার করা যায় না। যারা করেন, তারা অভিনব ও অনন্য হওয়ার লোভে করেন। কিন্তু বাস্তবত হয়ে পড়েন বিবিক্ত। আমার বক্তব্যের পক্ষে কয়েকটি বিচূর্ণ উদাহরণ :
একটি থেকে দশটি ভুলে গড়িয়ে পড়া ঠিক ছিলো না;
ছিন্ন হলাম, মাথামুণ্ডু ছিন্ন হলো, চতুর্দিকে রক্ততুফান,
বাউল দুপুর দগ্ধ হলো, ছিন্ন হলো চিৎপাহাড়ের
স্বর্ণলতা, কোত্থেকে আজ লাগলো হঠাৎ অভিশাপের কণা!
(‘টান দিয়েছে দশটি রুপার আঙুল’)
বা,
পাতায় পাতায়
আরও কিছু কথা
লেগেছিল বলে
ঝরে যায় পাতা —
হলুদবরণ।

ঝরে গিয়ে পড়ে
যমুনার কুলে
জোয়ারের টানে
বুকে তুলে নেয়
দীর্ঘ মরণ!
(‘পদাবলি’)
মানবীয় অনুভূতির স্বকীয় জটিলতা আছে, কল্পনার বিমূর্ততা আছে, চিন্তার অস্পষ্টতা আছে, প্রকাশের বৈচিত্র্য আছে। তাই কবিতা কখনো কখনো অপরিচয়ের দূরত্ব নিয়ে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে থাকে। পাঠক তার নৈকট্য লাভের প্রয়াসে বারবার তার দ্বারস্থ হতে চেষ্টা করেন। উপর্যুপরি গমনাগমনের মধ্য দিয়ে তার ভেতর থেকে বিচেত্র রস নিঙড়ে নিয়ে আসেন। কবিতার এই প্রবণতার ছলনায় কেউ কেউ কৃত্রিমভাবে জটিলতা বয়নের চেষ্টা করেন। সুমন সে পথে পা মাড়াননি। তার কোনো কোনো কবিতায় সরলভাবে উপস্থাপিত দুরূহতা আছে হয়তোবা, তা জীবন-লিপ্ত অভিজ্ঞতার ফসল। সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে, আলো ও আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবন-বিজড়িত নানা নর্ঞ্থকতা তার কবিতার উপজীব্য হয়েছে, এ কারণেই গ্রন্থনাম ‘পতনের শব্দগুলো’। এই নামকরণে আমাদের রূঢ় বাস্তবতা বা অন্তর্লোকের তমসা যৌথভাবে বিধৃত হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কোনো পাঠক ইউরোপীয় আধুনিকতার অবক্ষেপের আভাস, বা ‘ওয়েস্ট ল্যান্ডি’ দীর্ঘশ্বাসের উষ্ণতা লক্ষ করলে খুব দোষ দেয়া যাবে না।
কবিতাগুলোকে সুমন ছয়টি পর্বে (১. গার্হস্থসন্ন্যাস, ২. জনমান্ধ মুহূর্তের গান, ৩. লাল নীল নকশা, ৪. সহজিয়া স্তব্ধ শ্লোক, ৫. আট কুঠুরি নয় দরজা ও ৬. শেষ অভিজ্ঞান) ভাগ করেছেন, যা তার অতিসচেতনতার পরিচয়বহ, এই বিভাজন-প্রবণতা আমার ভালো লাগেনি। মনে হয়েছে পাঠকের প্রতি তাঁর আস্থার ঘাটতি রয়েছে। যদিও এই ধরনের বিভাজন নতুন কোনো ব্যাপার নয়, অনেক নিদর্শন এর আছে, আরো অনেক নজির তৈরি হবে। তবু পাঠককে সমালোচকের মতো আরেকটু শিক্ষিত করে তোলার মানসিকতা একজন কবির কাছে আমি প্রত্যাশা করি না। অন্তত এ ক্ষেত্রে করি না। এই তারল্যটুকু বাদ দিলে ‘পতনের শব্দগুলো’ গ্রন্থটিকে আমি একজন তরুণ কবির কাব্যপ্রজ্ঞার উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সন্দেহ নেই, সুমন সাজ্জাদ এ সময়ের খুব সম্ভাবনাময় কবি। এই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের দায় তাঁর। খ্যাতির মোহে কোনো গড্ডলপ্রবাহে গা ভাসিয়ে না দিলে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে। তাই :
তবে জমে উঠুক এই মুশায়রা; ‘সব কিছু
ভালো বুঝি? অমৃত-পুষ্প-আলিঙ্গন? বহুত খুব
হামসফর — অন্ধকারে চুপিসারে একটি দংশন’।
(‘মীরাবাঈ’)

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Prev
তুলনামূলক সাহিত্য : মৃত্যুর মিথ বনাম বাস্তবতা

তুলনামূলক সাহিত্য : মৃত্যুর মিথ বনাম বাস্তবতা

তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে বইটা লিখেছি প্রায় আট বছর ধরে। এই আট বছরে সংগ্রহ করেছি

Total
0
Share