আমার প্রথম বই; প্রথম প্রেমের মতো, প্রথম সব আনন্দের মতো। বইটি বেরিয়েছিল ২০০৭-এর ফেব্রুয়ারিতে। এ বই তৈরি হবার পেছনে কাজ করেছিল দুজন কবির আন্তরিক উদ্যোগ — সোহেল হাসান গালিব ও মাদল হাসান। গালিব তখন ক্রান্তিক নামে একটি ছোটকাগজ করতেন। ক্রান্তিকের একটি সংখ্যায় প্রথম পাণ্ডুলিপি ছেপেছিলেন তিনি। বই করার পরিকল্পনা তখন থেকেই জোরদার হতে আরম্ভ করেছে। প্রবল উৎসাহ জোগালেন মাদল হাসান। তিনি নিজেই লিখে দিলেন বইয়ের ফ্ল্যাপ। পরিচিতি অংশ লিখে দিলেন বন্ধু ও সহকর্মী খোরশেদ আলম; বইটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিল খোরশেদ।
মনে আছে, বইয়ের কাজে উত্তরায় গিয়েছিলাম গালিব ও মাদলের বাসায়। উত্তরা তখনও এতো ব্যস্ত আবাসনকেন্দ্র নয়। অনেক ফাঁকা জায়গা ছিল। রাস্তাগুলো তাই বড়ো মনে হতো। ওই সব রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দোটানায় পড়ে গিয়েছিলাম — বই করব, নাকি করবো না?
একটি কারণ ছিল এই — বইয়ে প্রকাশনা বাবদ খরচের টাকাটা আমাকেই বহন করতে হবে। কয়েক মাস আগে সদ্য বাবা হয়েছি। নতুন কিছু দায়িত্ব আছে। পকেটের শূন্য ভাঁড়ার নিয়ে ঘুরি ফিরি আর ভাবি, টাকা খরচ করে এইসব অতি-তুচ্ছ কবিতা ছেপে কী হবে! কেন পড়বে লোকে! তবু কথা যখন দিয়ে ফেলেছি গলিব ও মাদলকে, তখন বই বের করতেই হবে। একই সঙ্গে ভাবলাম, আমার কন্যা আর আমার বই — পাশাপাশি সময়েই থাকুক দুজন। অতঃপর দ্বিধা মুছে ফেললাম।
পতনের শব্দগুলোর প্রচ্ছদ করেছিলেন সব্যসাচী হাজরা। প্রচ্ছদ করিয়ে আনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন দুই কবি। কারণ আমার সঙ্গে কোনো শিল্পীর পরিচয় ছিল না। প্রকাশক কে? মাদল বললেন, সমুত্থানের নাম ব্যবহার করা হবে। তখন আজিজ সুপার মার্কেটে সমুত্থান নামে একটি সংগঠিন পরিচালিত হতো। মাদল তার সঙ্গে যুক্ত। গালিব আমাকে নিয়ে গেলেন নয়া পল্টনে। যদ্দূর মনে পড়ে একটা সিডিতে শুধু প্রচ্ছদের ছবিটা দেয়া ছিল। মানবেন্দ্র সুর প্রচ্ছদের গ্রাফিক্সের কাজ করে দিলেন। ছাপার কাজ দেয়া হয়েছিলো গল্পকার ও প্রকাশক পারভেজ হোসেনকে।
পারভেজ হোসেন ফোনে জানালেন, বই হয়ে গেছে। বললেন, সবগুলো কপিই নিয়ে যেতে হবে। গোডাওনে বই রাখার জায়গা নেই। বন্ধু খোরশেদকে সঙ্গে নিয়ে বই আনতে গেলাম। ভারি পাঁচটি কার্টুনে ৫০০ কপি বই! অকল্পনীয়! এতোগুলো বই নিয়ে যাবো কী করে! ভরসা হলুদ ট্যাক্সি ক্যাব। বেচারা বন্ধু খোরশেদ আলম বই টেনে অনেক কষ্ট করেছিল সেদিন।
শুকনো মুখে পকেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অবস্থা শোচনীয়। ফকিরাপুলে সত্যি সত্যি নিজেকে ফকির মনে হলো। কিন্তু বিকল্প পথ নেই। বাজার খরচ করার জন্য কিছু টাকা ছিল পকেটে। বাসায় আব্বা আসার কথা। সে জন্য বিশেষ কিছু বাজার করার কথা ছিল। সেই টাকা দিয়ে ট্যাক্সি ক্যাবে করে বইয়ের বোঝা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বলাবাহুল্য, ‘কহিল কবির স্ত্রী’, ‘এতো বই!’
হ্যাঁ, এতো বই। বইয়ের সাথে বাজার নেই। মাদল বলেছিলেন, প্রথম বই ৫০০ কপি তো করতেই হবে। উপহার-টুপহার দেয়ার ব্যাপার আছে। পত্রিকা অফিসগুলোতে পাঠাতে হবে। স্মৃতি বলে, কোথাও পাঠানো হয় নি। প্রীতিবশত অনেককে দিয়েছিলাম অবশ্য।
বই মেলায় যেদিন বই নিয়ে গিয়েছিলাম, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল। অসংখ্য বইয়ের ভেতর আমার মতো নবীনের বই কে কিনবে! তাছাড়া বইটি যে-ই হাতে নিচ্ছে, সে-ই ঝেড়ে নিচ্ছে; হাত দিয়ে পরিস্কার করে নিচ্ছে। প্রচ্ছদটাই এমন হয়েছে যে, দেখলে মনে হয় ধুলা লেগেছে। এসব কাণ্ড দেখে আরও একটু লজ্জিত হয়ে আমি লিটিল ম্যাগাজিন চত্বরে ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম। এরওর সঙ্গে কথা বলতাম। আমাকে বেশির ভাগ কবি-লেখকই চেনেন না। গালিব ও মাদল পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। তখন পর্যন্ত দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে একটি মাত্র কবিতা ছাপা হয়েছে। কিছু কবিতা ছাপা হয়েছিল লিটিল ম্যাগাজিনে।
একদিন লেখকদের আড্ডায় এলেন সলিমুল্লাহ খান। কবি শামীম রেজার হাতে আমার বইটি দেখে চেয়ে নিলেন। উল্টেপাল্টে বললেন, প্রচ্ছদটা সুন্দর, ধূসর পাণ্ডুলিপির একটা ছাপ আছে। যাক, সলিমুল্লাহ খান ধুলা ঝাড়েন নি।
কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ লিটিল ম্যাগাজিন চত্বরে স্টল দিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে বেশ কিছু বই বিক্রি হয়েছিল। আমি লাজুক লাজুক মুখ নিয়ে প্রতিদিন মেলায় যেতাম আর লজ্জিত মুখে ফেরত আসতাম। সরফরাজ বলতেন, আরও কিছু বই নিয়ে আইসেন। আমি আরও কিছু বই নিয়ে যেতাম। ‘আরও কিছু’ বইসহ পতনের শব্দগুলোর আশি কপি বিক্রি হয়েছিল। আমার জন্য যা ছিল বিশাল বিক্রি! যাঁরা কিনেছিলেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। একটি কপিও বিক্রি নাও হতে পারত। আমার বইয়ের বিক্রিভাগ্য যাই হোক, সমালোচনাভাগ্য ছিল দারুণ। দৈনিক সংবাদ, প্রথম আলো, যুগান্তর, ডেসটিনি গুরুত্বের সঙ্গে খবর ও রিভিউ ছেপেছিল। বেশ কয়েকটি লিটিল ম্যাগাজিনে সমালোচনা ছেপেছিল। আজ সেসব মনে পড়ে।
আর হ্যাঁ, ৫০০ কপি বইয়ের আরও কিছু কপি এখনও আছে…