কয়েক দিন ধরে উল্টেপাল্টে নজরুল পড়ছি। একটা কোর্স পড়াতে হবে, তাই প্রস্তুতির পালা। তারও কিছু দিন আগে নজরুলের গান নিয়ে ছোট্ট একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম; যদিও তখন জানতাম না নজরুল বিষয়ক কোনো কিছু পড়াতে যাচ্ছি। নজরুল রচনাবলি ঘেঁটে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারলাম প্রতিভা কাকে বলে! মাত্র বিশ-বাইশ বছরের লেখক জীবনে নজরুল যা লিখেছেন তার তুলনা মেলা ভার।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলির ১২টি খণ্ড আমার সামনে উপস্থিত। যতোই পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছি ততোই চোখে ভেসে উঠছে নজরুলের বিস্ময়-আপ্লুত গভীর ঘন চোখ-মুখ। ভেসে উঠছে চিরচেনা সেই সব ফটোগ্রাফ — বাঁশি বাজাচ্ছেন তিনি, ঝাঁকড়া চুল, সৈনিকের পোশাক, মাথায় লম্বা টুপি। তারুণ্যের ছবিগুলো যতো টানছে, বার্ধক্য ও নির্বাকতার ছবিগুলো ততোই মনকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ভাবছি, যে বয়সে তিনি নির্বাক হয়েছিলেন, আমি দাঁড়িয়ে আছি ঠিক তার কাছাকাছি সীমানায়। এই বয়সের ভেতরই নজরুল লিখে ফেলেছেন তার সমস্ত কালোত্তীর্ণ কবিতা ও গান। বাঙালির মর্মমহলে প্রবেশ করে গেছে অমর সব বাণী ও সুর।
বাড়তি আগ্রহের সঙ্গে হাতড়ে দেখলাম নজরুলের গানের বইগুলো। ভেবে দেখলাম, আমরা তার গদ্যপদ্যের বইয়ের যতো নাম জানি, গানের বইয়ের নাম ততো জানি না। বুলবুল কিংবা নজরুল গীতির বাইরে খুব বেশি বইয়ের নাম আমি কাউকে কখনো বলতে শুনি নি। এই যেমন, চন্দ্রবিন্দু, জুলফিকার, সুর-সাকী, গুল্-বাগিচা! আরও বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, নজরুলের এতো এতো গান আমি কবে শুনলাম! গানের কথা পড়তে গিয়ে দেখি, অনেক গানই আমি শুনেছি। উল্টো বিস্মিত হয়ে এও ভাবলাম, আরও কতোশতো গান, আমি শুনিই নি!
গত কয়েক দিনে বহুবার গুনগুন করে নজরুলের গান আওড়ে গেছি। সব চেয়ে বেশি মনে পড়েছে ছোটবেলায় শোনা গানটি, ‘এনেছি আমার শতজনমের প্রেম আঁখিজলে গাঁথা মালা।’ এই গান শুনেছিলাম রাস্তার মোড়ে ধোপার দোকানে। তখনই অনুপ ঘোষালের গলা, নজরুলের গান আর সুর মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। অবশ্য অনেক পরে জেনেছিলাম গলাটা অনুপ ঘোষালের, গানটা নজরুলের। এই গানটির জন্যই দুই-তিন টাকা দিয়ে একটা গানের বই কিনেছিলাম। নিউজপ্রিন্টে ছাপা সেই বইটির দাম আজও পরিশোধ করা হয় নি।
আমাদের এলাকায় মসজিদের পাশে ছিল করিম হুজুরের দোকান। সেখানেই সাজিয়ে রাখা নামাজ শিক্ষা, দোয়া দরুদের বইয়ের সারিতে ছিল দেশাত্মবোধক, আধুনিক ইত্যাদি শিরোনামের গানের বই। এ জাতীয় একটি বইয়েই ছিল ‘এনেছি আমার শতজনমের প্রেম…’। হুজুরকে বলেছিলাম, ‘হুজুর বইটা দেন, পরে টাকা দিমু।’ সেই টাকা আজও দেয়া হয় নি। বইটি অনেক দিন যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। বছর দশ-পনের আগেও ভাবতাম করিম হুজুরকে চমকে দিয়ে একদিন বাকি শোধ করে দিবো। হুজুর কি তিরিশ বছর পর তিন টাকা নেবে?
হায়, তখন কি জানতাম তিন টাকার দেনায় এতোখানি পাওনা ছিলো আমার!