ছন্দের শহরে একদিন

দ্যা কিস, গুস্তাব ক্লিমন্ট

ছন্দবদ্ধ কবিতা নিয়ে অনেকের দ্বিধা, সংকোচ ও অবজ্ঞা। আমি ছন্দ ভালোবাসি, যেমন ভালোবাসি অ-ছন্দ। ছন্দকে কখনোই দুর্বল কিছু মনে করি না। আমি বিশ্বাস করি, কবিতা বহু রকম, শিল্প বহু রকম। শিল্পে কোনো একরোখা একমুখিনতা নেই। জীবনের মতোই কবিতা বিচিত্র আর বহুমাত্রিক। প্রচলিত ছন্দের কিছু কবিতা রইল পাঠকদের জন্য।

ত্রিস্রোতা

‘বৃষ্টিকে চেন? — মেঘেদের বান্ধবী।
শুনেছি শ্রাবণ প্রথম প্রেমিক তার।
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল
বাতাসে ওড়ায় অস্ফুট হাহাকার।’

‘শ্রাবণকে চেন? — আকাশের সহচর।
শুনেছি শ্রাবণ বাদলের কথা জানে।
দূরদেশে ওড়ে বৃষ্টিমুখর মেয়ে।
থইথই স্মৃতি শ্রাবণের ঋতুগানে।’

‘বাদলও পড়েছে টুপটাপ স্বরলিপি।
শুনেছে হাজার বর্ষারাতের তান।
অঝোর নদীর করতলে ভাটিয়ালি।
মেঘবন্ধুরা দেখেছিল অবসান।’

‘বৃষ্টিকে দ্যাখো? — উড়ন্ত ছায়াপথ —
কার্নিভালের রঙভরা ফাল্গুনে।
আসছে আষাঢ় — মন-ভাসানের দিন
জারুলপাখিরা বৃষ্টির কাল গোনে।’

‘তবে কি এখন তিন দিকে গেছে স্রোত?
দেখে নি আকাশ একটি অন্ত্যমিলও।
চুপিসারে কেন মেঘদল বলে যায় —
শোনো হে আকাশ, কেউ ছিল, কেউ ছিল!’

তাকিয়ে আছে ফুলের দোকান

শরীর জুড়ে তরুণ ক্ষুধা বলগা হরিণ।
তুমি আমার হাতের ওপর ছড়িয়ে দিলে
এক মুঠো দিন — শস্যদানা।

এক মুঠো রাত লুকিয়ে নিলে আঁচল-পাড়ে।
নোংরা অটো। ব্যস্ত গলি। চমকে তাকাও
রঙবাহারে। বিড়াল ছানা।

আগুনবোমা ঝলসে ওঠে। সূর্য অস্ত।
দোলনচাঁপায় ঝড় লেগেছে। সন্ধ্যা মাতাল,
আদরগ্রস্ত। সাদায় কালোয়

অন্ধকারে হাসবে যখন শরীর দু’খান
তখন কিন্তু দোষ দিওনা। শহর জুড়ে
ফুলের দোকান। নিওন আলোয়

দোষ দিওনা, তরুণ ক্ষুধা বলগা হরিণ
হাতের ওপর ছড়িয়ে দিলে এক মুঠো দিন,
একমুঠো রাত কাঁটায় কাঁটায় শরীর দু’খান,
শহর জুড়ে তাকিয়ে আছে ফুলের দোকান…

প্যাপিরাস

লিখেছি তোমাকে ফাগুন-পত্র
প্যাপিরাসে লেখা দু-এক ছত্র।

পড়েছো কি তুমি? পড়ো নি তো জানি,
বুকে ফিসফাস। মনে কানাকানি।

চাঁদ ডুবুডুবু। নদী থরোথরো।
সবুজ পাতার রেখা পাঠ করো।

কী ছবি ফুটেছে? কী লেখা উহাতে?
কাঠকয়লায় আদিম গুহাতে?

রক্তপলাশে দরদি ঝিলিক
লাগে কি ভীষণ হায়ারোগ্লিফিক!

পড়তে কি পারো কালো অক্ষর?
ভবঘুরে মন-মেঘেদের স্বর?

পড়তে পারো নি? পারবে না জানি।
বুকে ফিসফাস। মনে কানাকানি।

সহজ

সহজ খুব বৃষ্টি এসেছিল।
সন্ধ্যা ছিল বিষণ্ণ এক টানেল।
রিকশা জুড়ে বজ্রপাতে ভেজা
দু’জন মানুষ দুঃখ টেনে আনে।

দু’জন মানুষ হাওয়ার ভেতর ভাসে।
ভাসতে ভাসতে বর্ষাকে দেয় ডাক।
রাতের গাড়ি হারায় ইস্টিশন।
রাস্তাগুলো ফাগুন হয়ে থাক।

ফাগুন তো নেই। ঝুম বৃষ্টি।
আগুনপথে ছলকে ওঠে জোয়ার।
সমুদ্র ওই উথালপাথাল, দূরে
দ্যাখো, আকাশ খোলা দুয়ার।

দুয়ারে কে? দুয়ারে কে? — ঢেউ।
বিজন মেঘে নৌকা তোলে পাল।
দু’জন মানুষ দুই দিকে যায় ছুটে
‘রেললাইন বহে সমান্তরাল।’

‘দুখের নাহি ওর’

শহরে ঘন মেঘ। শহরে ঘনঘোর।
চকিত বৃষ্টির ফাগুন-উচ্ছ্বাস।
পাথুরে নীল ঘর। দুখের নাহি ওর।

মেঘের ছায়া বলে, ‘ব্যথারা সখা তোর।’
রাস্তা ছুঁয়ে ওড়ে ঝাপসা মিনিবাস।
শহরে ঘন মেঘ। শহরে ঘনঘোর।

বৃষ্টি-সালফার। পুড়ছে ঘরদোর।
পাথর ভেঙে ভেঙে চলছে সিসিফাস।
পাথুরে নীল ঘর। দুখের নাহি ওর।

টাওয়ারে ভেজা পাখি। লৌহ পিঞ্জর।
একাকী। ডানাভাঙা। দগ্ধ বিশ্বাস।
পাথুরে নীল ঘর। দুখের নাহি ওর।

গাছের শাখা জ্বলে। জ্বলছে বাসা তোর।
পার্কে এভিন্যুতে পুড়ছে সব ঘাস।
শহরে ঘন মেঘ। শহরে ঘনঘোর।

তাহলে আজ তুই পুড়বি রাতভোর?
অথই বৃষ্টিতে পোড়াই অভ্যাস?
শহরে ঘন মেঘ। শহরে ঘনঘোর।
পাথুরে নীল ঘর। দুখের নাহি ওর।

মমি

তিনটি সিঁড়ি বেয়ে কোমল ঘর।
জংলি পাটাতন। ভূতের বাস।
পোড়ো সে বাড়িটিতে তীক্ষ্ণ স্বর —
‘শরীর কেটে তুই মাংস খাস?’

ঘরের একদিকে পুরনো কূপ।
অচেনা কূপে দেখি পাতাল, খাদ।
আঁধার পিরামিড। পুড়ছে ধূপ।
হাতড়ে যেতে যেতে বিসংবাদ।

জলজ গুল্মের শ্যাওলা ঝাড়।
প্যাঁচানো গোখরোর আরক বিষ।
ফণার মিশে যায় চুমুর ধার।
পদ্মমণি জ্বলে অহর্নিশ।

তিনটি সিঁড়ি বেয়ে কোমল ঘর।
প্রাচীন মমি কেটে শরীর ওই;
আসছে ভেসে ভেসে আদিম স্বর —
ছুরিকা লেলিহান — ‘মাংস কই?’

সন্ধ্যাগীতি

আহা কি সন্ধ্যাবেলা
পাহাড়ি নদীর ধারে
রুপালি চাঁদের ভাষা
জানো কে পড়তে পারে?

পাহাড়ের গোপন নদী
চিনে কে বাইতে জানে
ছেঁড়া পাল ভাঙা তরী
বাতাসের উল্টো টানে?

গাছেদের শিখর ছুঁয়ে
জানো কে আকাশ ওড়ায়?
জানো তো দিনের শেষে
ঢেউয়ে কে সূর্য পোড়ায়?

আহা কি সন্ধ্যাবেলা
পাহাড়ি বনের ধারে
হারানো চিত্রলেখা
বলো কে চিনতে পারে?

যে মেয়ে চিনতে পারে
ছোটে সে জন্মাবধি
পৃথিবীর বক্ষ চিড়ে
সে মেয়ে নিজেই নদী

আহা কি সন্ধ্যাবেলা
আহা কি সন্ধ্যাবেলা…!

মৃত্তিকাপুরাণ

পুরনো ঘর। পুরনো বাড়ি।
মরচে পড়া তালার ওপর পুরনো হাত।
অকস্মাৎ।

সুপুরি গাছ। সবুজ সারি।
মা দুর্গা। কাঁসর ঘণ্টা। দুর্বাদল।
‘ফিরিয়া চল।’

তুলসীতলা। সন্ধ্যাদীপ।
শিউলিভোর। ফুল কুড়ায় বিধবা থান।
দূর আজান।

সিঁদুর-লাল মেঘের টিপ।
‘এখনও তোর মন পোড়ায়? মন পোড়ে?’
অচিনপুরে।

‘কার ছেলে তুই? কী সাকিন?’
বুড়ো আয়নায় কুচকানো ত্বক, মাটির দাগ।
‘দেশভাগ?’

উড়তে উড়তে চিল পাখি
গুটায় ডানা। পালকে লেখা কর্পোরেট।
মুণ্ডুহেট।

পুরনো ঘর। পুরনো বাড়ি। পুরনো হাত।
পুরনো কাঁথা সেলাই করে পুরনো তাঁত…
অকস্মাৎ….

পাজেল

টুকরো টুকরো দৃশ্যের ভাঁজে
গাছগুলো ছিল। নদীটা উধাও।
অগোছালো দিন। পথ বন্ধুর।
রক্তকরবী। কাগজের নাও।

দেখতে দেখতে গোধূলির নাচ,
পাহাড়ের ঢালে দিগন্তশেষ।
‘ক্যাকটাস, তোর ফুটল না ফুল।’
মেঘলাটে মন — আঙিনা বিদেশ।

জানলা-উদাস ঘুমন্ত চাঁদ।
নীরবতা শেখে বুদ্ধের মুখ।
পরাজিত পাখি গ্রহে গ্রহে ওড়ে,
ছড়ানো ডানায় না-ওড়ার সুখ।

ভাঙাচোরা ছবি। খসে পড়া তারা।
উজানে ভাটিতে ব্যথা-টুংটাং।
‘পাশ-বালিশ কি বেদনাকে বোঝে?’
‘বন্ধু তো তবু…!’ রাত সুনসান।

বন্ধু তো তবু, বন্ধুতা জানে —
তুলোর পুতুল। অলীক আকাশ।
বেদনার পাশে বেদনাকে রাখে,
জংলি বিকেলে ইট-চাপা ঘাস।

রাত সুনসান। জিভে নোনা জল।
ধীরে নিভে জ্বলে আলোজ্বলা চোখ।
ছায়া-ছায়া ঘরে কেউ ফিরে আসে —
ভৌতিক প্রেম, রক্ত-অশোক।

সব কিছু ছিল। সব ঠিক আছে?
কাটা কাটা ছবি। কি দারুণ খেল।
মেলাতে চাইছ? জোড়া দিতে হবে।
জানো তো মানুষ ছড়ানো পাজেল?

ধারাপাত

সূর্য যখন রৌদ্র শেখায় বৃষ্টি শেখায় জল,
নদী তখন ঢেউয়ের কাছে শিখছে ছলাৎছল।

আকাশ যখন শূন্য লেখে বাতাস বলে, ‘ধুৎ,
মেঘ-দুপুরের ধারাপাতে বৃষ্টিরা অদ্ভ‚ত!’

নীলাভতার ছন্দ পড়ে মৃত্যু-সবুজ ঘাস,
মাটির গায়ে পদ্য আঁকা সামান্য অভ্যাস।

পাথর যখন আগুন শেখায়, ধনুক ছোড়ে তির,
উজান-গঙ্গা থমকে দেখে পাহাড়টা গম্ভীর।

এসব গল্প গুহাচিত্রের, পুরোনো তার ভাঁজ,
পাণ্ডুলিপি, দেয়াল-ছবি — পুরনো সাত-পাঁচ।

পাতায় পাতায় সহজ কথা, বৃক্ষ শেখায় ঘর।
মানুষ থেকে মানুষ তবু ভাঙছে পরস্পর!

এক-নদী জল

এক-নদী জল বর্ষা আসার আগে,
গাছে গাছে দ্যাখো বসন্ত বাঁধে ঘর,
হাজার ফুলের মৌসুমী অনুরাগে
প্রেমিকেরা শেখে কোকিলের অক্ষর।

কোকিল কী জানে?– বিরহী আলিঙ্গন।
আর জানে ঠিক মন নয় সহজিয়া,
পদাবলি লেখে রাধিকা-ব্যাকুল মন
সুরে সুরে গায় ‘ভ্রমর কইও গিয়া’।

ভ্রমর কী বলে? — যমুনা-উতল ভাষা।
কী কথা শোনায় শহুরে পাখির কানে?
— ‘বসন্ত জেনো রঙের জোয়ারে ভাসা।’
বিচ্ছেদ তবু রাধারমণের গানে।

এক-নদী জল বর্ষা আসার আগে
বর্ষা নেমেছে, যমুনা যে থইথই,
সব বসন্তে তোমাকে সুদূর লাগে,
এই বসন্ত? — হারাবার গল্পই!

তিস্তা

এত যে নদী — তোমার আমার ব্যক্তিগত,
এত যে খাদ উজানভাটি — বৃষ্টিহত,

এত যে ঝড়, চণ্ড হাওয়া– ভয়ংকরী,
তারই মধ্যে দু-এক পাতা অংক করি।

একটুখানি যোগবিয়োগ আর গুণ ও ভাগ,
বালির মধ্যে ঘুমন্ত সব ঝিনুক-দাগ।

ভগ্নাংশের এপার-ওপার শুকনো চড়া।
বাতাস বাউল। মৃত নদীর গন্ধ ওড়া।

অংক মেলে। শেষ বিকেলে শূন্য থাকে।
উড়িয়ে দেই খেয়াঘাটের শূন্যতাকে।

চুক্তিবিহীন অংকটা কি এতই সরল?
তোমার আমার তিস্তা জুড়ে নেই কোনো জল?

তোমার আমার তিস্তা জুড়ে নেই কোনো জল!
নেই কোনো জল, নেই কোনো জল, নেই কোনো জল…

যাত্রা

রাত্রি যখন জেগে ওঠে সন্ধ্যায়,
ভিড়গুলো ছোটে নির্জনতার বাড়ি,
পাখিদের মন নিভুনিভু তন্দ্রায়,
খেয়াঘাটে থামে ঢেউগুলো সারিসারি।

তখন গাছেরা কথা বলে চুপিচুপি,
জানালার ফাঁকে দীর্ঘ শ্বাসের হাওয়া —
ফিরে চলে স্মৃতি অদেখা ভবিষ্যতে,
ভাঙা পাল, তবু সমুদ্রে নাও বাওয়া!

তখন এ-পথে কেউ নেই। শুধু জানি,
ঝরা পাতা ওড়ে। অশ্রুত গান্ধার।
তারাটির সাথে তারাটির কানাকানি।
ডুবুডুবু নাও, সম্মুখে আন্ধার।

থই থই জল। ডুবে গেছে বাতিঘর।
পাটাতন কাঁপে। ঢেউ ভারি গম্ভীর।
কিনারার পথে যাবে যে পরস্পর —
মাড়িয়ে যাবে না জলার্ত কুম্ভীর?

ডুবুডুবু নাও, ধসে গেছে ছায়াপথ,
উজানে দ্যাখো রে মেঘেদের ডম্বর,
‘বাইয়া যাও মাঝি, অন্তর বাইয়া যাও।’
মেঘেরা ঢাকুক অনন্ত অম্বর।

রাত্রি যখন জেগে ওঠে সন্ধ্যায়,
আঁকড়ে ধরো কি খড়কুটো তৃণদল?
সামাল সামাল মন বুঝি ডুবে যায়!
আর কিছু নেই। মনটাই সম্বল।

নো এক্সিট

রাস্তা জুড়ে তোমার চুলের গন্ধ ভাসে,
এই বাতাসে নামল যখন তুমুল তুফান,
তোমার কাঁধে হাত রেখেছে বসন্ত-রাত,
উড়ছে ধুলো, ধূসর ব্যথা, দু-এক পাতা
রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে মেঘের ডালে
ফুল ফুটেছে গহিন কুসুম, পাপড়ি জ্বালে
অনেক আগুন, অনেক পোড়া ধূপের গন্ধ,
আমার কিন্তু নো এক্সিট, দরোজা বন্ধ,
জানালা বন্ধ…

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Prev
মুকুলের বউ সমাচার

মুকুলের বউ সমাচার

মুকুল পালের বউয়ের ব্যাপারটা বলতেই হয়; কারণ বিষয়টা রাশেদের ফ্যান্টাসির ভেতর

Next
শামসুর রাহমান/ বাংলাদেশের হৃদয়

শামসুর রাহমান/ বাংলাদেশের হৃদয়

১৯৪৭ সাল। বিভক্ত বঙ্গদেশ। চোখের সামনে তখন স্বপ্ন ও কল্পনার নতুন বসতি—পাকিস্তান।

Total
0
Share