খড়ের পুতুল

শিল্পী : ভ্যান গগ

গল্পের বই ভেবে এই বই পড়বেন না; বরং মলাট বন্ধ করুন। বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিন, নিজেকে ভাবুন। তাকিয়ে দেখুন, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে উচ্চতায় আপনি নিজেই বিরাট এক উপন্যাস; আপনি নিজেই হয়তোবা ক্রাইম এন্ড পানিশম্যান্ট কিংবা ঢাউস এক ওয়ার এ্যান্ড পিস। ভিক্টোর হুগো যদি ভালো লেগে থাকে, তাহলে নিজেকে ভেবে নিতে পারেন লা মিজারেবল


দস্তয়েভস্কি? ধুৎছাই! তলস্তয়? দাড়িওয়ালা ধর্মযাজক ও ধর্ষক! এবং অবশ্যই জমিদার! অবশ্য পরে জমিজমা সব বিলিয়ে দিয়েছেন। পরমেশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন। আহা বেচারা! কিন্তু আপনি? পাতায় পাতায় গল্প ঠাসা, শত শত হাজার হাজার চরিত্রের মাঝখানে আপনিই এক মহোত্তম নায়ক অথবা নায়িকা; আপনার চারপাশে নিঃশব্দ পদক্ষেপে ভিলেনেরা ঘুরছে।


মরূদ্যানের শান্ত-স্তব্ধ ছায়ার মতো আপনারও আছে এক বা একাধিক নায়িকা/নায়ক। আপনি তার/তাদের চুম্বনের নোনতা স্বাদ, স্পর্শের চুম্বক শিহরণ, সঙ্গমের ঢেউভাঙা আকুলতার কথা ভাবতে পারেন। ভেবে দেখুন, আপনার হাতের রেখায় লুকানো আছে কতো কতো ইতিহাস, বিলুপ্ত দিন, স্মৃতি। স্মৃতি মানেই তো আলো ও অন্ধকারের চিত্রনাট্য। জল হাওয়া আর নিশ্বাসের মতো সেগুলো ঘুরে ফিরে আসে।


আপনি হয়তো একটি নিধিরাম সর্দার। ঢাল নেই তলোয়ার নেই। হয়তো এতোটাই সফল যে, লিফটে উঠে ছাদ ফুঁড়ে আপনি আকাশ ছুঁয়ে ফেলেন অথচ নিজেকে খুঁজে পান না কোথাও। তাহলে, ধরে নিই আপনি ব্যর্থ? কী বলেন? রবীন্দ্রনাথের মতো আপাত-সফল। ‘আপাত-সফল’ কেন? আচ্ছা, আপনিই বলুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কী আছে রবীন্দ্রনাথে? ধুর! ন্যাকান্যাকা সব কথা। কোন এক সিনেমায় যেন শুনেছিলেন, ‘রবি ঠাকুর কেবল চলে যাবার কথা বলেন, ফিরে আসবার কথা বলেন না।’


ধরা যাক, কালকের রাতটা আপনার খুব ভালো গেছে। পার্টি ছিল। ডিসেম্বরের শীতে যে-রকম পার্টি হয়। আপনার সুদর্শন/সুদর্শনা বিবাহিত কলিগটি আপনার আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে দিয়েছে। একটুকু ছোঁয়া লেগেই যা হবার তাই হলো আর কি! কাচের গ্লাসে আঙুল ছুঁতেই পানিগুলো রঙিন হয়ে গেলো, মাথার ওপর ঝাঁক বেঁধে উড়তে থাকল প্রজাপতি। পুরোই মার্কেজীয় ব্যাপার। ম্যাজিক রিয়ালিজম। দু’য়েকটা ঘটনা এরকম ঘটেই থাকে, হঠাৎ করে; অথচ হৃদয়সুদ্ধো পুড়তে থাকে। তাই বলে কি একে ভালোবাসা, মন্দবাসা বলা চলে! কয়েকটা দিন জ্বালায়, এই তো।


কোনো কোনো দিন হয়তোবা অন্ধকার। পরিত্যাক্ত বাড়ির আনাচে কানাচে পড়ে থাকা স্মৃতিগুলোকে জোড়া দিয়ে দেখতে পান সবুজ শৈশব, নারকেল পাতার চশমা, হাত ঘড়ি, মার্বেল অথবা পুতুলের সংসার। তারপর? ভাঙা কালভার্টের নিচে নবজাতকের লাশ। কার ছেলে গো? আহা, কী ফুটফুটে! মানুষের কাজ এইসব? দুপুরবেলার ভাত খাওয়া হলো না আপনার। কোথায় সেই সব! ত্রিশ বছর আগের কুপিবাতি জ্বলা ঘুমন্ত গ্রামের ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছে সেসব।


তারপর? অন্ধকার সিঁড়িতে আপনাকে জাপটে ধরে চুমু খেলো একজন। তারপর? মেঘলা যাত্রী ছাউনিতে একজন বলল, ‘তুমি এতো কুল! টিকটিকিও ততোখানি কুল না।’ তারপর? আপনি হয়তো ভাবেন, মায়ের প্রেমিক দেখতে কেমন ছিল। বাবার মতো সুন্দর? তারপর? যার হাতের তালুর ভেতর কালো বিন্দুর মতো তিল ছিল, তার হাতের ভেতর নাক ডুবিয়ে তুলে নিলেন সমস্ত পৃথিবীর মিষ্টি গন্ধ। তারপর? উপবাসী মন। তারপর? কতো কতো সন্ধ্যায় ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করেছে দেয়ালের রেলিং থেকে।
প্যাঁপ্যাঁ…ভু…উ…উ… প্যাঁপ্যাঁ… আপনার ধ্যান ভাঙে।

গাড়ির জানালায়, ‘খালাম্মা বইটা নিবেন? খুব ভালা বই। গরিব মানুষ। বইটা নিবেন?’ কিংবা, ‘আঙ্কেল, ফুলগুলা নেন। চল্লিশ ট্যাকা দিয়েন।’ আপনি হয়তো হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো নিতে চান। কিন্তু কাকে দেবেন? মৃত মানুষ ছাড়া কাকে ফুল দেবেন আপনি? খ্রিস্টান কবরখানায় ঘুমিয়ে থাকা মেরিলিন রোজারিওর এপিটাফের ওপর বিছিয়ে দেবেন — ‘ওয়ান্স মিট, নেভার ফরগটেন।’ আপনার ভেতর থেকে পৃথিবীর দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে।


আপনি হয়তো বইটার দিকে তাকিয়ে দেখেন, ‘পজিটিভ মাইন্ড’। হুম, আপনার পজিটিভ হওয়া দরকার। বি পজিটিভ। কিংবা হাতড়ে দেখেন দালাই লামার হ্যাপিনেজ বিষয়ক মিষ্টি মিষ্টি কথা। ‘দ্যা আর্ট অফ হ্যাপিনেজ/ অ্যা হ্যান্ডবুক ফল লিভিং’। আপনার হ্যাপিনেজও দরকার। সুখ। থেরাপিস্ট বলেছে। থেরাপিস্ট মানে, সাইকো থেরাপিস্ট। বেঁচে থাকতে হলে এই শহরে এসব লেগেই থাকে। কিন্তু হ্যান্ডবুক কোথায়?


কিংবা ধরুন, ওই যে, আপনার সেই ছেড়ে যাওয়া মানুষটা! কী সুন্দর — বউ অথবা স্বামী নিয়ে…! স্বর্গবাস? না, না! ওটা বললে মৃত্যু-মৃত্যু গন্ধ লাগে! সেদিন কে যেন বলল, খুব ভালো আছে। কক্সবাজার-পাতায়া-সিঙ্গাপুর। একেবারে রাম-সীতা। লাইলি-মজনু। আর কী কী যেন আছে না। তা থাকুক।


সে যাই হোক, আপনার পজিটিভিটি দরকার। আপনি তাই দুটো গান, একটি বই, আধখানা সিনেমা, ইউটিউব, প্রোফাইল পিকচার — এইসব করেন টরেন। হায়, তবু কোথায় সে? হিরোশিমা পুড়ে যায়, নাগাসাকি পুড়ে যায়। সমুখে নাকি শান্তিপারাবার!


যতো খারাপই হোক বউ তো/ স্বামী তো! তিনটি ঘর, দেয়াল, জানালা, দরোজা, আসবাব; এসবের ভেতরে থাকা একটা মানুষ তো। হোক না সে ওয়ালম্যাট, ফ্লাওয়ার ভাস। ট্রেনে কাটা পড়ল। ছিন্নভিন্ন শরীর। কেন পড়ল? ইচ্ছেমৃত্যু? স্বেচ্ছায় মৃত্যু বেছে নেয়া মানুষের দলে আপনি নেই। আপনি জানেন না, কেন সে মৃত্যুর কাছে কড়া নাড়ল। নাকি মৃত্যুই তাকে চেয়েছিল? কে জানে?


অন্ধকার টানেলের শেষ প্রান্তে শেষ আলোর মতো কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকে আপনার জন্যে। বলে, ‘ভেবো না। আছি তো।’ বলে, ‘এতো সুন্দর তুমি! মনে হয়, তোমার হাতে হাত রেখে মরে যাই।’ মহাকাব্যিক এই মিথ্যের সামনে আপনি হয়তো হাসেন; স্বর্ণলতার মতো দুলে ওঠে আপনার উপবাসী মন, উপবাসী শরীর।


কিন্তু তারপরও… হ্যাঁ, তারপরও… আপনি হয়তো একটি খড়ের পুতুল। তবু আপনার হাত আছে, পা আছে, মাথা আছে, চোখ আছে। একটি হৃদয়ও আছে। সবই জ্যান্ত। তাহলে কেন আপনি অন্যের লেখা বানোয়াট আর স্টুপিড গল্পের ভেতর ঢুকতে যাবেন? এই মুহূর্তে আপনি নিজেই একটা গল্প। কিংবা অজস্র গল্পের ঝুড়ি। গল্পগুলো জোড়া দিতে দিতে আপনি একটা উপন্যাস। উপন্যাসগুলো জোড়া দিতে দিতে আপনি একটা আস্ত জীবন।


দয়া করে গল্পের বই ভেবে বইটা পড়বেন না। দয়া করে গল্প ভেবে গল্পটা পড়বেন না।

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Prev
এন্ড্রু কিশোর : মৃত্যুর মৌসুমে বিষণ্ণ প্রস্থান

এন্ড্রু কিশোর : মৃত্যুর মৌসুমে বিষণ্ণ প্রস্থান

এন্ড্রু কিশোর—সদ্যমৃত এক নক্ষত্রের নাম; মৃত্যুর এই মৌসুমে আমাদের বিষণ্ন ও মৌন

Next
জয়নুল আবেদিন : মন্বন্তর, জাতীয়তাবাদ ও আত্মপরিচয়

জয়নুল আবেদিন : মন্বন্তর, জাতীয়তাবাদ ও আত্মপরিচয়

লোকে তার ছবি দেখুক আর না-ই দেখুক—সবাই জানে তিনি আঁকিয়ে; জয়নুল আবেদিন—বাঙালির

Total
0
Share